সকাল ৯টায়ও সূর্যের তাপ খুব বেশি চড়েনি। চারদিকে তখনো হেমন্তের কুয়াশার আভা। খুলনা নগরে মানুষের ব্যস্ততা শুরু হয়েছে। ইজিবাইক, রিকশা, প্রাইভেট কারগুলো ছুটে চলছে এদিক-সেদিক। তবে ব্যস্ততা নেই ময়লাপোতা মোড়ের উত্তর দিকে সড়কের পাশে বসে থাকা জনা পঁচিশ মানুষের। কারও বয়স ২৫, আবার কারও ৬০। তাঁদের কারও কাছে কোদাল, কারও কাছে রাজমিস্ত্রির কাজ করার যন্ত্র। আবার কারও কাছে আছে কাঠের কাজ করার যন্ত্রপাতি।
কোনো মোটরসাইকেল বা ইজিবাইক সেখানে থামলেই ওই সব মানুষের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি পড়ছে আরোহীর ওপর। আর কোনো আগন্তুক যদি তাঁদের কোনো একজনের সঙ্গে কথা বলার উদ্যোগ নিচ্ছেন, তাহলে সবাই মিলে ঘিরে ধরছেন সেই আগন্তুককে। কিছুক্ষণ পর হতাশ হয়ে ফিরে আসছেন। আজ বুধবার সকালের চিত্র এটি।
সময় যত গড়াচ্ছে, মুখগুলো তত মলিন হচ্ছে। তাঁরা সবাই দিনমজুর। সারা দিনের জন্য নিজেদের শ্রম বিক্রি করতে ভোর ছয়টা থেকে সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন। সাড়ে ৯টার দিকেও বিক্রি হননি। তাই সেদিনের মতো কাজে যাওয়ার আশা ছেড়ে দেন তাঁরা। হতাশ হয়ে অনেকে বাড়ির পথে হাঁটতে শুরু করেন। অনেকেই আবার চিন্তায় পড়ে যান।
এ সময় কথা হয় কবির হোসেনের সঙ্গে। বয়স ৩৬ বছরের মতো। তিনি রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করেন। থাকেন রূপসা উপজেলার বাগমারা গ্রামে। ময়লাপোতার মোড় থেকে ওই এলাকার দূরত্ব প্রায় ১০ কিলোমিটার। কাজ পাওয়ার আশায় প্রতিদিন সেখান থেকে পায়ে হেঁটে আসেন তিনি। কবির হোসেন বলেন, ‘গত বৃহস্পতিবার এক দিনের জন্যি কাজ পাইছিলাম। এর মধ্যি আর কোনো কাজ পাইনি। মালিক-মাহাজনরা আর আসতিছে না। কাজকাম নাই, এখন খামু কী?’
কবির হোসেন বলেন, ‘প্রায় ১০-১২ দিন ধরে এমন সমস্যা হতিছে। নির্বাচনের কারণে কাজ খনেক কুমে গেছে। ১ দিন কাজ করলি ৬০০ টাকা পা যায়। কিন্তু ওই টাকা দিয়ে এখন কি আর হয়? তারপরও প্রতিদিন কাজ হলি বা সপ্তাহে তিন দিন কাজ করতি পারলি সংসার ট্যানেটুনে চালিয়ে নেয়া যায়। এখন প্রতিদিন খালি পকেটে বাড়ি ফিরতি হচ্ছে।’ তাঁর এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে আর মেয়ের বয়স ছয় বছর।
কবির হোসেনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে চারপাশ দিয়ে ঘিরে ধরেন আরও জনা দশেক। তাঁদের একজন মো. কামরুল। তিনি নগরের সোনাডাঙ্গা এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন। কামরুল বলেন, ‘শুক্রবার শেষ কাজ করিছি। এরপর বসে আছি। প্রতিদিন আসতেছি কিন্তু কাজ পাচ্ছি নে। এখন বাসা পর্যন্ত হাঁটি যাতি হবে। তারপর কারও কাছ থাকি টাকা ধার নিয়ে বাজার করি বাসায় যাতি হবে। তা না হলি বাসায় দুপুরের খাবার জুটবি ন্যা।’
ওই শ্রমজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, খুলনা নগরের ময়লাপোতার মোড়, সাত রাস্তার মোড় ও শিববাড়ী মোড়ে প্রতিদিন সকালে শ্রম হাট বসে। শত শত লোক নিজেদের শ্রম বিক্রি করতে সেখানে হাজির হন। যাঁর ভাগ্য ভালো থাকে, তিনি কাজ পান। সবচেয়ে বেশি শ্রমজীবী মানুষের সমাগম হয় ময়লাপোতার মোড়ে। আগে প্রায় প্রতিদিনই সবাই কাজ পেতেন। তবে গত এক মাস অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে কাজ অনেক কমে গেছে। এখন অর্ধেকের কম মানুষ কাজ পাচ্ছেন।