ঘূর্ণিঝড় মিগজাউমের প্রভাবে টানা বৃষ্টিতে আলু উৎপাদনের জন্য প্রসিদ্ধ মুন্সিগঞ্জের কৃষকদের মাথায় হাত পড়েছে। অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে আলুখেতে জমেছে পানি। এতে সদ্য রোপণ করা বীজ আলু পচে গিয়ে কোটি টাকা লোকসানের শঙ্কায় আছেন চাষিরা। এর আগেও গত ১৭ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় মিধিলির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হন জেলার আলুচাষিরা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, অক্টোবর থেকে আলু আবাদের মৌসুম শুরু হয়। তবে মুন্সিগঞ্জে পুরোদমে আলু আবাদ শুরু হয় নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে। এ বছর জেলায় ৩৪ হাজার ৩৪৬ হেক্টর জমিতে আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ১৬ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ করা হয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশ আলু গত ৮-১০ দিন আগে আবাদ করা হয়েছে।
মুন্সিগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবদুল আজিজ প্রথম আলোকে বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের বিষয়ে কদিন আগে থেকেই তাঁরা কৃষকদের বলে আসছিলেন। যার ফলে অনেকেই আলু রোপণ করেননি। যাঁরা করেছেন, তাঁরাও জমিতে নালা কেটে রেখেছিলেন। যদি কোনো জমিতে জলাবদ্ধতার তৈরি না হয়, তাহলে আলুর ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকবে না। যদি জলাবদ্ধতা হয়, সেখানে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। তবে কী পরিমাণ ক্ষতি হতে পারে, সেটি কয়েক দিন পরে বলা যাবে।
তবে মাঠের চিত্র ভিন্ন। অধিকাংশ কৃষকই আলু রোপণ করেছেন। গতকাল বুধবার রাত থেকে টানা বৃষ্টির কারণে জেলার অধিকাংশ আলুর জমিতে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। আজ সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার টরকির, রমজানবেগ, পাঁচগরিয়াকান্দি, যুগনীঘাট, দক্ষিণ চরমসুরা এলাকা ঘুরে জলাবদ্ধতার এমন চিত্র দেখা যায়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, টঙ্গিবাড়ী, গজারিয়া, সিরাজদিখান ও শ্রীনগরের আলু জমিতেও পানি জমে আছে।
এসব এলাকার কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা হলে তাঁরা জানান, মুন্সিগঞ্জ সারা দেশের মধ্যে আলু উৎপাদনে সেরা। তবে এ জেলার জমিগুলো তুলনামূলক নিচু। বর্ষার পানি দেরি করে জমি থেকে নামে। তাই প্রতিবছর নভেম্বরের ১৫ তারিখের পর থেকে আলুর আবাদ শুরু করা হয়। এবার মৌসুমের শুরুতে ঘূর্ণিঝড় মিধিলির কারণে কিছু জমিতে আলু লাগিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন কৃষকেরা। জমির পানি শুকানোর পর ১০-১২ দিন ধরে আবারও তাঁরা ব্যাপকভাবে আলু লাগানো শুরু করেছিলেন। কৃষকেরা জানান, জেলার অর্ধেকের বেশি জমিতে আলু লাগানো শেষ হয়ে গিয়েছিল। গত দুই দিনে টানা বৃষ্টিতে সদ্য লাগানো আলুর জমিতে পানি আটকে গেছে। এতে বীজ আলু নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ফলে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বেন কৃষকেরা।
দক্ষিণ চরমসুরার এলাকার আলুচাষি নিরব আহম্মেদ ২ থেকে ৪ ডিসেম্বর ২৪০ শতাংশ জমিতে আলুর আবাদ করেন। বৃষ্টিতে তাঁর সেই জমি এখন পানিতে ভর্তি। নিরব বলেন, ‘প্রথম ঘূর্ণিঝড়ের (মিধিলি) কারণে এমনিতে আলু আবাদে এবার ৮-১০ দিন বিলম্ব হয়েছে। জমি প্রস্তুত করে প্রায় তিন লাখ টাকা খরচ করে আলু চাষ করেছিলাম। জমিতে পানি জমে সব শেষ হয়ে গেল। আমার মতো আমাদের এলাকার সবার অবস্থা। নালা করেও জমির পানি সরানো যাচ্ছে না।’
টঙ্গিবাড়ী উপজেলার আউটশাহী এলাকার আলুচাষি মো. শাহীন জানান, জমির পানি সরাতে বুধবার রাত তিনটা থেকে বৃহস্পতিবার বিকেল চারটা পর্যন্ত একটানা কাজ করেছেন। কিন্তু টানা বৃষ্টির কারণে নালা করেও জমির পানি সরানো যাচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘শুক্রবারে গিয়ে বৃষ্টি থামলেও মাটিচাপায় জমির আলুতে পচন ধরবে। যদিও কোনো জমিতে সৌভাগ্যবশত গাছ গজায়, সেগুলোও ছত্রাকের আক্রমণে পড়বে। এককথায় এবারের আলু শেষ।’
আলুর ঘাটতি থাকায় এবার খাবার আলুর দাম পূর্বের সব রেকর্ড ভেঙে ৬০-৬৫ টাকা কেজি ধরে বিক্রি হয় খুচরা বাজারে। এ দামের প্রভাব পড়ে বীজ আলুর দামের ওপরও। ৭০-৭৫ টাকা কেজি ধরে বীজ আলু কিনতে হয় কৃষকদের। বৃষ্টিতে আবাদ করা আলু নষ্ট হলে সংকট পড়বে বীজ আলুতেও।
একই অবস্থা গজারকান্দি এলাকার আলুচাষি আমজাদ ব্যাপারীর। নভেম্বরের মাঝামাঝি আলু চাষ তিনি করেন। মিধিলির জন্য সে সময় আলু চাষ করে চার লাখ টাকার ক্ষতি হয় বলে দাবি তাঁর। টাকাপয়সা ধারদেনা করে আবার আলু লাগানোর পর আবার বৃষ্টি। এতে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে আমজাদ ব্যাপারী কপালে। তিনি বলেন, ‘বৃষ্টির পানিতে আমাগো সব ভাইসা গেল। লাভের আশায় ধারদেনা কইরা আলু লাগাইলাম। দুই দিনের বৃষ্টিতে সব শেষ হইল।’