মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের ফটকে লাগানো নৌকার প্রার্থীর পোস্টার। গতকাল সকালে
মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের ফটকে লাগানো নৌকার প্রার্থীর পোস্টার। গতকাল সকালে

মুন্সিগঞ্জ–৩ আসন

বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিএনপিকে কাছে টানার চেষ্টা মৃণালের

মুন্সিগঞ্জের মুক্তারপুর সেতু থেকে নামলেই পঞ্চসার জোড়পুকুর এলাকা। কাছাকাছি দূরত্বে নৌকা ও কাঁচি প্রতীকের প্রার্থীর নির্বাচনী কার্যালয়। দুই প্রার্থীর পোস্টার-ব্যানারও প্রচুর। চায়ের দোকানে বসা পঞ্চসারের বাসিন্দা সত্তরোর্ধ্ব মনির হোসেন বললেন, ‘প্রচারে দুজনই তো সমান সমান, কে জিতবেন, বলা যায় না।’

মুন্সিগঞ্জ-৩ (সদর ও গজারিয়া) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী গত দুইবারের সংসদ সদস্য মৃণাল কান্তি দাস। তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক। তাঁর বিপরীতে কাঁচি প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন দুইবারের পৌর মেয়র মোহাম্মদ ফয়সাল (বিপ্লব)। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. মহিউদ্দিনের ছেলে।

স্থানীয় লোকজন ও দলীয় নেতারা জানান, মৃণালের পাশে আওয়ামী লীগের নেতাদের দেখা যাচ্ছে না। মুন্সিগঞ্জ জেলা, উপজেলা ও পৌর আওয়ামী লীগের পুরো কমিটি কাজ করছে স্বতন্ত্র প্রার্থী ফয়সালের পক্ষে। মৃণাল প্রচার চালাচ্ছেন অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনকে নিয়ে। একই সঙ্গে তিনি বিএনপির ভোটার-সমর্থকদের কাছে টানার এবং তাঁদের ভোটকেন্দ্রে আনতে উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করছেন।

মুন্সিগঞ্জ-৩ আসনে মোট প্রার্থী ১০ জন। তবে নির্বাচনের প্রচারে নৌকা ও কাঁচি প্রতীকের বাইরে অন্যদের সেভাবে দেখা যাচ্ছে না। জাতীয় পার্টির প্রার্থীর কিছু পোস্টার দেখা গেছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে পঞ্চসার জোড়পুকুর এলাকায় নৌকা প্রতীকের পক্ষে প্রচারের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন মুন্সিগঞ্জ জেলা কৃষক লীগের সভাপতি শেখ মনিরুজ্জামান। এ সময় তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মূল দল আওয়ামী লীগের কেউ দলীয় প্রার্থীর পক্ষে নেই। জেলা, উপজেলা ও পৌর আওয়ামী লীগের পুরোটাই কাঁচি প্রতীকের পক্ষে। নৌকার প্রার্থী মাঠে আছেন অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের নিয়ে। 

স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১১ সালের পৌর নির্বাচনে ফয়সালের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন মৃণাল কান্তি দাস। এর পর থেকে তাঁদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে। নেতা-কর্মীরাও দুই ভাগে বিভক্ত হতে থাকেন। সমর্থকদের মধ্যে একাধিক সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। 

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মৃণাল ও ফয়সাল দুজনই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চান। মনোনয়ন পান মৃণাল কান্তি দাস। স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলেছেন ফয়সাল। 

মুন্সিগঞ্জ সদর ও গজারিয়া উপজেলা নিয়ে গঠিত এই আসন। আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, স্বতন্ত্র প্রার্থী ফয়সালের বাবা দীর্ঘদিন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। এই আসনের সংসদ সদস্যও ছিলেন। জেলার রাজনীতিতে ফয়সালের পরিবারের আগে থেকেই ভালো অবস্থান রয়েছে। 

এবারের নির্বাচনে মুন্সিগঞ্জ সদর ও গজারিয়া উপজেলার অধিকাংশ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং পদধারী নেতারা সরাসরি ফয়সালের পক্ষ নিয়েছেন। দলের নেতারা বলছেন, নৌকা প্রতীকের প্রতি আবেগ থেকে নেতা-কর্মীদের একটা অংশ মৃণালের পক্ষে আছে। 

এত দিন মৃণাল কান্তির লোক হিসেবে পরিচিত ছিলেন মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও চরকেওয়ার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আফসার উদ্দীন ভূঁইয়া। এবারের নির্বাচনে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী ফয়সালের পক্ষে কাজ করছেন। আফসার উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা নৌকার পক্ষে। তবে এবার যিনি নৌকার মাঝি হয়েছেন তাঁর বিপক্ষে। মৃণাল কান্তি আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছে টানেননি। নিজের পছন্দের কয়েকজনকে নিয়ে চলাফেরা করেছেন।’

তবে মৃণাল কান্তি প্রথম আলোকে বলেন, দলের নেতারা পক্ষে না থাকলেও তৃণমূলের মানুষ তাঁর সঙ্গে আছে। তিনি বলেন, ‘জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিও দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে, এটা দুর্ভাগ্যজনক। যাঁরা স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন, তাঁদের নৌকায় আরোহণ করতে অনুরোধ করছি।’ 

বিএনপির নেতাদের প্রশংসা

মুন্সিগঞ্জ জেলার এ আসনে ২০০৮ সালের আগে টানা চারবার জয়লাভ করে বিএনপি। এখানে দলটির ‘ভোটব্যাংক’ রয়েছে। স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, নৌকার প্রার্থী এখন বিএনপির ভোটারদের কাছে টানা এবং তাঁদের কেন্দ্রে আসতে উৎসাহিত করার চেষ্টা করছেন।

এ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবদুল হাইয়ের গ্রামের বাড়ি পঞ্চসার ইউনিয়নের মুক্তারপুর এলাকায়। তিনি অসুস্থ থাকায় এখন দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাঁর ছোট ভাই ও দলটির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক মহিউদ্দিন আহমদ। 

গত শনিবার পঞ্চসার এলাকায় একটি নির্বাচনী সভায় অংশ নেন মৃণাল কান্তি। সভায় আবদুল হাই, তাঁর ভাই মহিউদ্দিন এবং এই ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা হাবিবুর রহমানের কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে প্রশংসা করেন মৃণাল। তিনি বিএনপির এই নেতার রোগমুক্তির জন্য দোয়াও চান। তিনি ওই এলাকার বিএনপি সমর্থক ভোটারদের কাছে নৌকার পক্ষে ভোটও চান। 

বিএনপির ভোট চাওয়ার প্রসঙ্গে মৃণাল কান্তি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কে ধানের শীষ, কে নৌকার লোক, তা বিভেদ করি নাই। দলমত–নির্বিশেষে সবাইকে কেন্দ্রে এসে ভোট দিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছি। জনগণের প্রতি আন্তরিক ব্যক্তিকে জেতাতে বলছি।’

এই আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ ফয়সালও বিএনপির ভোটারদের ভোট চাইছেন বলে জানা গেছে। 

তবে মুন্সিগঞ্জ শহর বিএনপির সদস্যসচিব মাহবুব আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের প্রার্থী ক্ষমতায় আসতে আমাদের ভোটার ও সমর্থকদের বিভিন্ন কৌশলে টানার চেষ্টা করছেন। আমরা ভোট বর্জনের প্রচারপত্র বিলি করছি। যাঁরা প্রকৃত বিএনপির লোক, তাঁরা কেউ ভোট দিতে যাবেন না।’ 

সংঘাত, শঙ্কা

প্রচার শুরুর পর থেকেই মুন্সিগঞ্জ-৩ আসনে নৌকা ও কাঁচির সমর্থকেরা মুখোমুখি অবস্থানে আছেন। এ পর্যন্ত সংঘর্ষ, গুলি, হুমকি, দলীয় কার্যালয় ভাঙচুরসহ দুই পক্ষের মধ্যে অন্তত ১০টি ঘটনা ঘটেছে। নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটির কাছে দুই প্রার্থীর বিরুদ্ধে ৯টি অভিযোগ জমা পড়েছে। দুই পক্ষ একে অপরের বিরুদ্ধে ছয়টি মামলাও করেছে। 

স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, দুজনই শক্তিশালী প্রার্থী। ইতিমধ্যে দুই পক্ষ সংঘর্ষেও জড়িয়েছে কয়েক দফা। ফলে এ নির্বাচনে এখানকার মানুষের আগ্রহের পাশাপাশি আশঙ্কাও রয়েছে।