বন্যাকবলিত ফেনী সদর উপজেলার ১০ নম্বর ছনুয়া ইউনিয়নের উত্তর টঙ্গিরপাড় হাজিবাড়ি এলাকায় এক পরিবারের সাতজন চার দিন ধরে আটকে আছেন। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। কোনো নৌকাও উদ্ধারে যেতে পারছে না।
ওই পরিবারের আরেক সদস্য শিক্ষক ফারজানা আক্তার আছেন চট্টগ্রাম নগরে। তিনি আত্মীয়ের সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করেছেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে লোক পাঠিয়েছেন। কিন্তু লাভ হয়নি। মহাসড়ক থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরের গ্রামটিতে কেউ পৌঁছাতে পারেননি। সরু সড়ক ও পানির প্রবল প্রবাহের কারণে কেউ যেতে পারছেন না।
ফারজানা আক্তার গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, এলাকাটি পুরো ডুবে গেছে। শিশুসহ তাঁর পরিবারের সাতজন আটকে আছেন। একটি ভবনের দ্বিতীয় তলায় সবাই আশ্রয় নিয়েছিলেন। পানি উঠে গিয়েছিল দ্বিতীয় তলার সিঁড়িতে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাতটায় ফারজানা আক্তার সর্বশেষ ভাবি তানিয়া আক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছিলেন। খুদে বার্তা পাঠিয়ে তানিয়া জানান, তাঁরা সবাই এলাকার একটি মসজিদে আশ্রয় নিয়েছেন। ভবনের একতলা ডুবে দ্বিতীয় তলার সিঁড়ি পর্যন্ত পানি চলে এসেছে। মসজিদে গ্রামের কয়েক শ মানুষ আছেন। পথঘাট ডুবে যাওয়ায় কেউ বের হতে পারছেন না। এরপর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
ভাই বানের পানি সব ভাসাইয়া নিছে। দুই দিন ধরে কিছু খাই না। আশ্রয়কেন্দ্রে খাবার যায় নাই। কিছু খেতে দেন, পেটে খিদা।মো. কাইয়ুম, ছাগলনাইয়া উপজেলার বাসিন্দা
শুধু ফারজানার আত্মীয় নন, তাঁদের মতো আরও অসংখ্য মানুষ প্রত্যন্ত গ্রামে আটকে আছেন। এতে আত্মীয়স্বজনের অনেকেই ফেনীর পথে পথে অপেক্ষা করছেন। কোনোভাবে একটা নৌকার ব্যবস্থা করে যাওয়ার চেষ্টা করছেন কেউ কেউ।
গতকাল এমন ১৩ জনের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তাঁদের একজন মোহাম্মদ আলাউদ্দিন। তাঁর বাড়ি ফেনী সদর উপজেলার ফরহাদনগর ইউনিয়নের নৈরাজপুর গ্রামে। আলাউদ্দিন
জানান, চাকরিসূত্রে তিনি সীতাকুণ্ড থাকেন। তাঁর মা, স্ত্রী ও সন্তানেরা থাকেন বাড়িতে। পানির পরিমাণ বেশি হওয়ায় তিনি কোনোভাবেই গ্রামে পৌঁছাতে পারছেন না।
গতকাল দুপুরে আলাউদ্দিন মিরসরাইয়ের বারইয়ারহাট থেকে কখনো হেঁটে, কখনো ত্রাণবাহী ট্রাকে চেপে নৈরাজপুর গ্রামে ঢোকার মুখে গিয়ে নামেন। পরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘুম নাই, খাওয়াদাওয়া নাই। দুশ্চিন্তায় দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।’
ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী, পরশুরাম, ফেনী সদর, দাগনভূঞা ও সোনাগাজী—এ ছয় উপজেলা পুরোপুরি বন্যাকবলিত। গ্রামের পর গ্রাম ডুবে আছে। বাড়িঘরে কোনো জনমানব নেই। বন্যাকবলিত কয়েক লাখ মানুষ প্রাণ বাঁচাতে স্থানীয় স্কুল-কলেজ, মসজিদ ও মন্দিরের ভবনে উঠেছেন। সুপেয় পানি ও খাবারের সংকট আরও প্রকট হয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে যাওয়া ত্রাণবাহী ট্রাক ও উদ্ধারের কাজে যুক্ত স্বেচ্ছাসেবীরা প্রত্যন্ত গ্রামগুলোয় পৌঁছাতে পারছেন না। রাস্তার ধারের গ্রামগুলোয় তাঁরা ত্রাণ দিচ্ছেন। উদ্ধার করছেন আটকে পড়াদের। স্বেচ্ছাসেবীরা জানিয়েছেন, গতকাল সকাল সাতটা থেকে বিকেল পর্যন্ত বিভিন্ন গ্রামের অন্তত ৭০ জনকে তাঁরা উদ্ধার করেছেন।
ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার খাইয়ারা রাস্তার মাথায় হঠাৎ একটি ত্রাণবাহী ট্রাক এসে থামে। তখন ঘড়ির কাঁটা দুপুর ১২টার ঘরে। এক দল অসহায় লোক একদৌড়ে ট্রাকের দিকে ছুটে যান। ততক্ষণে সবাই জেনে গেছেন, ট্রাকে ছিল বিরিয়ানি। কাছে গিয়ে দেখা গেল, দেড় শ মানুষের জন্য মিরসরাই থেকে বিরিয়ানি রান্না করে এনেছেন এক দল স্বেচ্ছাসেবক। সাদা প্যাকেটে মোড়ানো বিরিয়ানি বিলি শুরু হলো।
এর মধ্যে মো. কাইয়ুম নামের এক চল্লিশোর্ধ্ব কৃষক স্বেচ্ছাসেবকদের বলেন, ‘ভাই বানের পানি সব ভাসাইয়া নিছে। দুই দিন ধরে কিছু খাই না। আশ্রয়কেন্দ্রে খাবার যায় নাই। কিছু খেতে দেন, পেটে খিদা।’
প্যাকেট হাতে পাওয়ার পর কাইয়ুম প্রথম আলোকে বলেন, ১২ বছরের এক ছেলে ও আট বছরের এক মেয়ে তাঁর। পরিবারের আরও চার সদস্যসহ উঠেছেন আশ্রয়কেন্দ্র। একটু দূরে হওয়ায় কোনো ত্রাণ ওই কেন্দ্রে পৌঁছায়নি। তাই অনেকেই সাঁতার কেটে মহাসড়কে এসেছেন। কোনো ট্রাক পেলে সামনে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন।
ফেনী ইস্ট ওয়েস্ট ডিগ্রি কলেজে আশ্রয় নিয়েছেন কয়েক শ মানুষ। বুকপানি ঠেলে সেখানে পৌঁছানোর পর দেখা গেল করুণ দৃশ্য। বন্যাকবলিত মানুষেরা গা ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকছেন। কলেজের দুটি ভবনের বারান্দায় গরু, হাঁস–মুরগিও বাঁধা ছিল।
চার দিন ধরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অচল। মিরসরাই থেকে ফেনী সদরের লালপোল পর্যন্ত প্রায় ৪০ কিলোমিটারে শত শত যানবাহন আটকা। তবে বিকেলের দিকে একটি, দুটি ট্রাক ঢাকার দিকে এগোচ্ছিল।
রাজ্জাক মিয়া সড়কের পাশে বসে ভাত রান্না করছিলেন। তিনি জানান, তিন দিন ধরে বসে আছেন। কিছু চাল ছিল। তা রান্না করেছেন। লবণ দিয়ে ভাত খাবেন।
ঢাকাগামী একটি বাসে ৩০ জনের মতো যাত্রী ছিলেন। তার মধ্যে তিনটি শিশুও ছিল। যাত্রীরা বলেন, কী যে মুসিবত, তা বলে বোঝানো যাবে না। কয়েকজন যাত্রী শুক্রবার রাতে হেঁটে রওনা দিয়েছেন। যতটুকু যেতে পারেন।