ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডুর হিজলী গ্রামকে ‘স্মার্ট গ্রাম’ করতে কাজ করে যাচ্ছেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. হাসান হাফিজ। তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা শেষ করে ২০১১ সালে চাকরিতে যোগ দেন। সাধারণ একটি গ্রামকে কীভাবে ‘স্মার্ট গ্রাম’ করছেন, তা নিয়ে প্রথম আলো কথা বলেছে তাঁর সঙ্গে।
হরিণাকুণ্ডু হিজলী গ্রামকে ‘স্মার্ট গ্রাম’ করার চিন্তা আপনার মাথায় কীভাবে আসে?
হাসান হাফিজ: বর্তমান সরকার সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় দেশের প্রায় প্রতিটি মানুষকেই কিছু না কিছু সাহায্য–সহযোগিতা দিয়ে থাকে। যখন আমরা নির্দিষ্ট করে কাউকে খুঁজতে যাই, তখন খুঁজে পাই না। এটার বড় কারণ হলো ডকুমেন্টেশনের অভাব এবং কাজগুলো ছাড়া ছাড়াভাবে করা হয়ে থাকে। এতে করে যখন আমরা আমাদের বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের অর্জনগুলোকে হাইলাইট করতে পারি না, তখন থেকে এই ভাবনার শুরু। ২০২১ সালে হরিণাকুণ্ডু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুস্মিতা সাহার সঙ্গে আলাপে জানতে পারি, তিনিও এমন কিছু ভেবেছেন। পরে দুজনের আইডিয়ার একটি চূড়ান্ত রূপ দেওয়া হয়। আমরা হিজলী গ্রাম নিয়ে কাজ শুরু করি।
শুরুতে কাজটা কীভাবে করেছেন?
হাসান হাফিজ: শুরুর দিকে কাজটা অতটা কঠিন মনে হয়নি। তবে অনেকগুলো কাজ শুরু করার পর আবার ভিন্নভাবে নতুন করে সাজাতে হয়েছে। শুরু থেকে শুরু করতে হয়েছে। অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য ছিল সরকারের বাড়তি টাকা খরচ না করে কাজটা বাস্তবায়ন করা। আমরা এমন একটি মডেল তৈরি করতে চেয়েছিলাম যেটা বাংলাদেশ, এমনকি বিশ্বের অন্যান্য দেশ মডেল হিসেবে গ্রহণ করতে পারে।
সবচেয়ে পরিশ্রমের কাজটা ছিল সার্ভে করে তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ করা এবং সেখান থেকে উপকারভোগী খুঁজে বের করা। সেখানে আমার দুজন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা ও দুজন তথ্য সহকারী সাহায্য করেছেন। এরপর সার্ভের তথ্য বিশ্লেষণ করে যখন বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের উপকারভোগীদের কাজের তালিকা তৈরি হয়ে গেল, তখন ইউএনও মূল কাজটা করলেন। উপজেলা পরিষদে হস্তান্তরিত সব বিভাগকে একসঙ্গে করা, তাদের দৈনন্দিন কাজের মধ্যে আমাদের আলাদা করা ৫০টি নির্ধারিত কাজকে সেট করা এবং সে অনুযায়ী কাজগুলো বাস্তবায়ন করা। সরকারি দপ্তরের বাইরে যেসব এনজিও তাদের কাজ হরিণাকুণ্ডুতে করে থাকে, তাদেরও সহায়তা নেওয়া হলো। নির্ধারিত ৫০টি কাজের যেগুলো যার সঙ্গে যায়, সেগুলোকে বাস্তবায়ন করার জন্য লিখিত নির্দেশনা দেওয়া হয়। সময় সময় সেগুলোর আপডেট রাখা হয়। আমি মূলত এখানে একজন সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেছি।
এখন পর্যন্ত কতটুকু সফল হতে পেরেছেন বলে মনে করেন?
হাসান হাফিজ: আমরা সার্ভে করে যে ৫০টি নির্ধারিত কাজ নির্বাচন করেছিলাম; যেখানে শিক্ষা, চিকিৎসা, কৃষি, কর্মসংস্থানসহ স্মার্ট বাংলাদেশের যে চারটি ভিত্তি, সেগুলোর সবই ছিল। আমরা সেগুলোর প্রায় শতভাগ কাজ সম্পন্ন করেছি। এখন শুধু কাজগুলো যেন আমরা চলে যাওয়ার পরও টিকে থাকে, সে জন্য কাজ করে যাচ্ছি।
সব কটি কাজ শেষ হলে গ্রামের কতটুকু উন্নত হবে?
হাসান হাফিজ: স্মার্ট হিজলি গঠনের সবচেয়ে বড় ও সফল কাজটা ছিল আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশনের সাবসেন্টারটি স্থাপন করা। এখানে যে ৪০ জন নারী এখন প্রতি মাসে ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা উপার্জন করছেন, তাঁরা একসময় জীবন নিয়ে হতাশ ছিলেন। এখন তাঁদের কাজের মান দিনে দিনে বাড়ছে, আশপাশের গ্রাম থেকেও নারীরা এসে কাজের সুযোগ চেয়ে যোগাযোগ করছেন। এটা একসময় আরও বাড়বে বলে আমার আশা। এ ছাড়া লাইব্রেরি স্থাপন, টেন মিনিটস আইটি, যুব ক্লাব ইত্যাদির কাজের দীর্ঘমেয়াদি যে প্রভাব, তা প্রত্যক্ষ করতে অনেক সময় লাগবে।
এ প্রকল্প নিয়ে নতুন কোনো ভাবনা আছে?
হাসান হাফিজ: আমার বিশ্বাস, আমরা এই গ্রামের প্রায় ৩৩৪টি পরিবারের সবার কাছে পৌঁছাতে পেরেছি। এটা ঠিক, সবাইকে প্রত্যক্ষভাবে সরকারি সব সুবিধা দেওয়া সম্ভব না। তবে আমরা যে পথ দেখিয়ে দিয়েছি, সেটা অনুসরণ করে গ্রামের অন্যরা তাঁদের নিজ নিজ রাস্তা খুঁজে পাবেন। যে পদ্ধতিতে আমরা কাজ করেছি, সেটি মডেল আকারে ডকুমেন্টেশন করে এবং আরও কিছু গ্রামে পাইলটিং করে দেশের অন্যান্য গ্রামে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করা দরকার।
এই উদ্যোগ নিয়ে গ্রামের মানুষের মধ্যে কেমন সাড়া পেয়েছেন?
হাসান হাফিজ: শুরুতে অনেকেই বিশ্বাস করতে পারেননি যে কোনো কাজ হবে। তবে একটা পর্যায়ে যখন তাঁরা বুঝতে পারলেন আমরা সত্যি সত্যি গ্রামটিকে পরিবর্তনের ব্রত নিয়ে মাঠে নেমেছি, তখন তাঁদের পক্ষ থেকে অনেক সহযোগিতা পেয়েছি। শেষ দিকে গ্রামের লোকজন আমাদের আপন করে নিয়েছিলেন। ঈদের পরে তাঁদের আমন্ত্রণে হিজলীতে যেতে হয়েছে। আমি কাজ করতে গিয়ে লক্ষ করলাম, আমরা যদি সরকারি সেবাগুলোকে ঠিকঠাক পৌঁছে দিতে পারি, তাহলে মানুষ আপন করে নেন।
এই মডেল নিয়ে সরকারি পর্যায়ে কোনো আলোচনা হয়েছে? তাদের প্রতিক্রিয়া কী?
হাসান হাফিজ: আমরা আমাদের এই হিজলী মডেল নিয়ে যখন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি, তখন তিনি তাঁর নিজের নির্বাচনী এলাকায় এমনটা করতে চেয়েছেন। শুরুর দিকে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী তাঁর ফেসবুক পেজে হিজলী গ্রামের বদলে যাওয়ার গল্প শেয়ার করেছিলেন। প্রথম আলোর প্রথম পাতায় এই গ্রামের গল্প প্রকাশিত হলে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের রুরাল আর্কিটেক্ট ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক তাঁর ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে পরিদর্শনে আসার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
সরকারের স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার যে পরিকল্পনা, সে ক্ষেত্রে আপনাদের এই স্মার্ট গ্রাম কতটুকু ফলপ্রসূ হবে?
হাসান হাফিজ: একটি গ্রামের পরিবর্তন শুধু সেই গ্রামের নয়, চারপাশের আরও গ্রামের উন্নয়ন। এভাবে এগোতে পারলে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ করা শুধুই সময়ের ব্যাপার।