শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সিলেট অঞ্চলের প্রথম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এটি ১৯৯১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু করে। এটি প্রতিষ্ঠার এক দশক পর ২০০১ সালে সিলেটে প্রথমবারের মতো লিডিং ইউনিভার্সিটি নামের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পায়। বর্তমানে সিলেটে ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি আছে সাতটি মেডিকেল কলেজ। আছে সিলেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজসহ অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
সময়টা পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি। তখন সিলেটে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। তাই উচ্চশিক্ষার জন্য সিলেটের ছয় সহপাঠীর সঙ্গে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন মো. আবদুল আজিজ। ঢাকা শহরে জায়গির থেকে কষ্ট আর দুর্ভোগকে সঙ্গী করে তিনি স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর শেষ করেন। এর সাড়ে চার দশক পর নব্বইয়ের দশকের শুরুতে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে মূলত সিলেটে প্রথমবারের মতো উচ্চশিক্ষার দুয়ার খুলে যায়। এর আগে উচ্চশিক্ষায় আগ্রহীদের গন্তব্য ছিল ঢাকা, চট্টগ্রাম কিংবা রাজশাহী।
মো. আবদুল আজিজ নিজের উচ্চশিক্ষার সময়কার গল্প শুনিয়েছেন তাঁর আত্মজীবনী কালের যাত্রার ধ্বনি বইয়ে। তাঁর মতো সিলেটের অনেক প্রবীণ শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিককে সিলেটের বাইরে গিয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে হয়েছে। তাঁরা কী ধরনের সমস্যায় পড়েছেন, তা উঠে এসেছে তাঁদের লেখায়। তবে সেসব এখন অতীত। বর্তমানে সিলেটে ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি রয়েছে সাতটি মেডিকেল কলেজ। আছে সিলেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজসহ অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ফলে এখনকার গল্পটা শুধুই শিক্ষাদীক্ষায় সিলেটের এগিয়ে যাওয়ার গল্প।
১৯৯১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু করা শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সিলেট অঞ্চলের প্রথম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এটি প্রতিষ্ঠার এক দশক পর ২০০১ সালে সিলেটে প্রথমবারের মতো লিডিং ইউনিভার্সিটি নামে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পায়। এরপর সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, সিলেট মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি, নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ এবং আরটিএম আল কবীর ইন্টারন্যাশনাল টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি নামের আরও চারটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়।
২০০৬ সালের ২ নভেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় নামের আরেকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। পরে ২০১৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ২০২০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ২০২০ সালের ১৮ নভেম্বর সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নামের আরও তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে। তবে এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কেবল হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ভর্তি শুরু করেছে। এ ছাড়া সিলেটের জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্টে আর্মি ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানেও উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।
বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সূত্র জানিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বর্তমানে প্রায় ২৩ হাজার শিক্ষার্থী নানা বিষয়ে পড়াশোনা করছেন। এর বাইরে সিলেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, সিলেট মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজ, মদনমোহন কলেজ, সিলেট সরকারি মহিলা কলেজ, সিলেট সরকারি কলেজ, হবিগঞ্জের বৃন্দাবন সরকারি কলেজ, সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজ ও মৌলভীবাজার সরকারি কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আরও অন্তত ৬৫ হাজার শিক্ষার্থী স্নাতক (পাস), স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তরে পড়াশোনা করছেন। প্রতিবছরই কৃতিত্বের সঙ্গে অসংখ্য শিক্ষার্থী এসব প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করে বের হচ্ছেন।
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. বদরুল ইসলাম শোয়েব ১৯৯১ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তরে ভর্তি হন। তিনি বলেন, ‘তখন সিলেটে উচ্চশিক্ষার জন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। তাই আমরা বহুদূরের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। তবে এখন সময় বদলেছে। সিলেটে এখন অসংখ্য সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। বলা চলে, হাতের নাগালেই উচ্চশিক্ষা। ফলে এ অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার দ্বার এখন অবারিত হয়েছে।’
সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির কোষাধ্যক্ষ নিতাইচন্দ্র চন্দ সিলেট এমসি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, সিলেটে অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় বিভাগের তৃণমূল পর্যায়ের শিক্ষার্থীরাও উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ পাচ্ছেন। ফলে উচ্চশিক্ষার হার ক্রমাগত বাড়ছে এবং তৃণমূল পর্যায়ে উচ্চশিক্ষার ঝরে পড়ার হারও কমছে।
শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি ও শিক্ষার্থীর অভিভাবকসহ সিলেটের অন্তত ১২ জনের সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। তাঁরা বলেন, দূরবর্তী এলাকায় গিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে হতো, সে কারণে উচ্চশিক্ষার আগেই অনেকের পড়াশোনা থেমে যেত। এখন সিলেটে এই হার কমেছে। তবে সিলেটে অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয় হলেও বৈচিত্র্যপূর্ণ বিষয়ে পড়ার সুযোগ খুবই কম। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত, নাট্যকলা, চারুকলা, সাংবাদিকতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে পড়ার সুযোগ নেই। বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়েই গৎবাঁধা কিছু বিষয় নিয়ে পড়তে হয়। সিলেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজকে পূর্ণাঙ্গ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবি তাদের।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা বলেন, শিক্ষার মান ও পড়ালেখার পরিবেশ নিয়ে তাঁদের মধ্যে কোনো অভিযোগ নেই। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই দক্ষ ও মেধাবী শিক্ষক আছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও অত্যাধুনিক ল্যাব, লাইব্রেরিসহ অবকাঠামোগত পর্যাপ্ত সুবিধা আছে। তবে আবাসনসংকটের কারণে অনেককে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হল থাকলেও পর্যাপ্ত আসন নেই। মেসে থাকার কারণে শিক্ষার্থীর পড়াশোনার খরচ বেড়ে যায়।
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অধ্যাপক মো. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, সরকার উচ্চশিক্ষাকে এখন সবার দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছে। কারণ, অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী গ্রামগঞ্জে আছেন, যাঁদের সিলেট কিংবা ঢাকায় গিয়ে পড়াশোনা করার সক্ষমতা নেই। তাঁরা যেন বাড়ি থেকেই উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন, এটা বিবেচনা থেকেই সরকার জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করছে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়কে শিক্ষার গুণগত মানের দিকে নজর দিতে হবে, তাহলে উচ্চশিক্ষায় সিলেট আরও এগিয়ে যাবে।
দেশের প্রথম কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু করা আরটিএম আল-কবীর টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির অবস্থান সিলেট নগরের পূর্ব শাহী ঈদগাহ এলাকায়। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ৩০০ শিক্ষার্থী আছেন। বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন আহমেদ আল-কবীর এবং উপাচার্য হিসেবে আছেন অধ্যাপক আবু জাফর নাসের উল্লাহ।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এখানে তিনটি ফ্যাকাল্টির অধীনে ৯টি প্রোগ্রাম চালু আছে। সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার হাইটেক পার্কে ৮ একর জায়গার ওপর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের কাজ চলছে। আউটসোসিং ডিপ্লোমা কোর্সসহ ইংরেজি ও জাপানিজ ভাষা শিক্ষা কোর্স চালুর প্রক্রিয়া চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার সৈয়দ জগলুল পাশা বলেন, ফ্যাশন ডিজাইনসহ কারিগরি শিক্ষাসংশ্লিষ্ট যুগোপযোগী বিষয়ে এখানে স্নাতক (সম্মান) পড়ানো হয়ে থাকে। ভবিষ্যতে নিত্যনতুন বিষয় চালু করার চিন্তাভাবনা আছে। এ ছাড়া একটা স্কিলড ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট চালুর পরিকল্পনাও আছে।