অ্যাসিডদগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া গৃহবধূ মিলি আক্তারের মা ও স্বজনদের আহাজারি থামছে না
অ্যাসিডদগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া গৃহবধূ মিলি আক্তারের মা ও স্বজনদের আহাজারি থামছে না

১০ মাস লড়ে অ্যাসিডদগ্ধ গৃহবধূর মৃত্যু

মায়ের আদর বুঝতেই পারল না ৯ মাসের সন্তানটি

‘আমার মাইয়া কী দোষ করছিল? কেন অ্যাসিড মাইরা মাইয়াডারে শেষ কইরা দিল? দুধের একটা সন্তান রাইখা সে চইলা গেল। বাচ্চাডার মুখের দিকে তাকাইতে পারি না। কষ্টে বুক ফাইটা যায়। আমার সব শেষ হইয়া গেল। যারা অ্যাসিড মাইরা মাইডারে মারল, তাগো ফাঁসি চাই।’ আহাজারি করতে করতে কথাগুলো বলছিলেন অ্যাসিডদগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার গৃহবধূ মিলি আক্তারের (২১) মা রাশেদা বেগম।

আজ মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামে মিলি আক্তারের স্বামীর বাড়িতে বসে আহাজারি করছিলেন রাশেদা বেগম। উপজেলার পশ্চিম সুজাতপুর গ্রামে পৈতৃক বাড়িতে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি দুর্বৃত্তের ছোড়া অ্যাসিডে দগ্ধ হন অন্তঃসত্ত্বা মিলি আক্তার। ১০ মাসের বেশি সময় মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে গতকাল সোমবার বিকেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।

মতলব উত্তর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে দুর্গাপুর বাজার। বাজারের খানিকটা পশ্চিমে প্রধানিয়া বাড়ি। এটি মিলির স্বামীর বাড়ি। তাঁর স্বামী আবু সায়েম প্রধান ও শ্বশুর মুসা প্রধান সৌদি আরবে থাকেন। আজ দুপুরে ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে অনেক মানুষের জটলা। সবাই মিলির লাশের অপেক্ষায়।

অ্যাসিডদগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার গৃহবধূ মিলি আক্তার

আহাজারি করতে করতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন মিলির মা রাশেদা বেগম। নীরবে চোখের পানি মুছছিলেন পাশে বসা মিলির শাশুড়ি শিখা বেগম, বোন শেফালী আক্তারসহ আরও অনেকেই। মিলির ৯ মাস বয়সী ছেলেসন্তান মো. আপনান নানি আর দাদির কোলে উঠে ইতিউতি তাকাচ্ছিল। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে এর কোল থেকে ওর কোলে যাচ্ছে। ছেলেটা মায়ের আদর কী বুঝতে পারল না, সেই কথাই বারবার বলছিলেন উপস্থিত লোকজন।

মিলির শাশুড়ি শিখা বেগম বলেন, মিলি তাঁর বড় ছেলের বউ। অ্যাসিডদগ্ধ হওয়ার পর গত ২ এপ্রিল মিলি সন্তানের জন্ম দেন। তখন থেকে তাঁর কাছেই রাখছেন আপনানকে।
মিলির বাবা আইয়ুব আলী বলেন, মিলির লাশের ময়নাতদন্তের কাজ ঢাকায় হয়েছে। সেখান থেকে লাশটি অ্যাম্বুলেন্সে করে দুর্গাপুরে আনা হচ্ছে। জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁর লাশ দাফন করা হবে।

পুলিশ, স্বজন ও স্থানীয় সূত্র জানায়, গত ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে উপজেলার পশ্চিম সুজাতপুর গ্রামে মিলি ও তাঁর মা রাশেদা বেগমের ওপর দুর্বৃত্তরা অ্যাসিড ছুড়ে পালিয়ে যায়। অ্যাসিডে মিলির মুখ, বুক, পিঠ, ডান হাতসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ ঝলসে যায়। তাঁর মা রাশেদা বেগমের ডান হাত, বুক ও ঊরু ঝলসে যায়। এ সময় তাঁদের চিৎকার শুনে পরিবারের সদস্য ও এলাকার লোকজন সেখানে যান। গুরুতর আহত অবস্থায় স্বজনেরা তাঁদের উদ্ধার করে প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন। সেখান থেকে ওই রাতে দগ্ধ মিলিকে ঢাকার জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করেন।

এ ঘটনায় গত ২৬ ফেব্রুয়ারি মিলির বাবা আইয়ুব আলী বাদী হয়ে পাশের গ্রামের শফিকুল ইসলাম ওরফে মানিক ও মো. জাহিদকে আসামি করে থানায় মামলা করেন। ১০ মাসের বেশি সময় ধরে মিলিকে ঢাকার বারডেম, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা দেওয়া হলেও অবস্থার উন্নতি হয়নি।

মতলব উত্তর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রবিউল হক বলেন, এ ঘটনায় করা মামলার ওই দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হয়েছে। গ্রেপ্তার আসামিরা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।