প্রকাশিত হয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান তৃতীয় বর্ষের ফলাফল। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে সমাজবিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছেন মোহাম্মদ ওয়াসিম। গতকাল বুধবার প্রকাশিত ফলাফল জানতে পেরেছেন ওয়াসিমের পরিবার, বন্ধু, আত্মীয় সবাই। শুধু জানতে পারেননি ওয়াসিম। গত ১৬ জুলাই বিকেলে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে নিহত হয়েছেন তিনি।
আন্দোলনে চট্টগ্রামের প্রথম মৃত্যুবরণকারী ওয়াসিমের বাড়ি কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের বাঘগুজারা বাজারপাড়া এলাকায়। ছেলের ফলাফল জেনে কান্নায় ভেঙে পড়েন ওয়াসিমের মা জোসনা বেগম। তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার সবই আছে, শুধু নেই ওয়াসিম। বাড়ির পাশেই মাটির নিচে শুয়ে আছে ছেলেটা। মনে হয়, এখনই আমার কাছে ফিরে আসবে। বলবে, দেখো মা আমি পাস করেছি। তোমার দোয়া কাজে লেগেছে। এবার চাকরি করব। সবাই বলছে সে ভালো রেজাল্ট করেছে। আমার ভেতরে দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। আমি থাকতে পারছি না আমার বুকের ধনকে ছাড়া। সে বেঁচে থাকলে কত আনন্দ করত, খুশি হতো। তা দেখে গর্ব করতাম আমিও।’
ওয়াসিমের বাবা সৌদিপ্রবাসী শফিউল আলম। দুই ভাই তিন বোনের মধ্যে ওয়াসিম দ্বিতীয়। ২০১৭ সালে পেকুয়ার মেহেরনামা উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ২০১৯ সালে বাকলিয়া সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন ওয়াসিম। পরে চট্টগ্রাম কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা শেষে ফলের অপেক্ষায় ছিলেন ওয়াসিম। গত ঈদের পরপরই শুরু হয় পরীক্ষা। প্রতিটি পরীক্ষার আগেই মাকে ফোন দিয়ে দোয়া নিয়ে তারপর হলে ঢুকতেন। সেসব বলে অঝোরে কেঁদে ওঠেন জোসনা বেগম।
দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া ওয়াসিমের ছোট বোন সাবরিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘ভাইয়া সব সময় পড়াশোনা করতে বলত। আজ ভাইয়া নাই। আমি বেঁচে আছি। ভাইয়ার রেজাল্ট আমি দেখছি, সে দেখতে পারছে না।’
ওয়াসিমের ফলাফলের ছবি পোস্ট করে সামিয়াত আমিন নামের একজন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘অনার্স তৃতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট অনুযায়ী চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ওয়াসিম ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। শহীদ ওয়াসিমের রেজাল্ট এসেছে। কিন্তু সে আর আসবে না কোনো দিন। দেশের জন্য তার আত্মত্যাগ জাতি কি মনে রাখবে?’
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শুরু থেকেই সক্রিয় ছিলেন মোহাম্মদ ওয়াসিম। ১৬ জুলাই বিকেলে চট্টগ্রাম নগরের ষোলশহর স্টেশনে আন্দোলনের পূর্বনির্ধারিত বিক্ষোভ কর্মসূচি ছিল। কিন্তু এর আগেই ছাত্রলীগ ও যুবলীগ স্টেশন চত্বর দখলে নেয়। ওই সময় ছাত্র-জনতা মুরাদপুরে সমবেত হন। বেলা পৌনে তিনটার দিকে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের গুলিতে ওয়াসিমসহ তিনজনের মৃত্যু হয়। আহত হয় অন্তত দেড় শ ছাত্র-জনতা। নিহত বাকি দুজন হলেন নগরের ওমর গনি এমইএইচ কলেজের শিক্ষার্থী ফয়সাল হোসেন ও ফার্নিচার দোকানের কর্মচারী ফারুক হোসেন।
ওয়াসিম চট্টগ্রাম কলেজ শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ও পেকুয়া উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ছিলেন। মৃত্যুর এক দিন আগে ১৫ জুলাই নিজের ফেসবুক টাইমলাইনে ছাত্রদলের নেতাদের সঙ্গে একটি ছবি পোস্ট করে তিনি লেখেন, ‘সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশে আমার প্রাণের সংগঠন। আমি এই পরিচয়ে শহীদ হব।’
গত ১৮ আগস্ট ওয়াসিমের মা জোসনা বেগম নগরের পাঁচলাইশ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান নওফেলসহ ১০৮ জনকে আসামি করা হয়।