উৎসমুখে বাঁধ দেওয়ায় ইছামতী নদী পরিণত হয়েছে খালে। এখন আর নেই সাঁতার কাটার অবস্থা। ফলে সেই সোনালি সময় নেই বৃশালিখা মহল্লার।
পাবনার বেড়া পৌরসভার বৃশালিখা মহল্লার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ইছামতী নদী। দুই দশক আগেও এ নদী ছিল চওড়া ও খরস্রোতা। এ নদীতে সাঁতার কেটে নিজেদের প্রস্তুত করেছেন মহল্লার তরুণেরা। হয়ে উঠেছেন কৃতী সাঁতারু। এ কারণে বৃশালিখা ‘সাঁতারুদের মহল্লা’ বলেও পরিচিত। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এ মহল্লার সাঁতারুরা কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।
উৎসমুখে বাঁধ দেওয়ায় ইছামতী নদী পরিণত হয়েছে খালে। এখন আর নেই সাঁতার কাটার অবস্থা। ফলে সেই সোনালি সময় নেই বৃশালিখা মহল্লার। এখন আর এ মহল্লা থেকে উঠে আসে না কৃতী সাঁতারু। বৃশালিখা মহল্লাসহ বেড়া উপজেলার সাঁতারুদের জন্য সুইমিংপুল নির্মাণের আশ্বাস দিয়েছিলেন অনেক জনপ্রতিনিধি। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন তিনজন মন্ত্রীও। দীর্ঘদিন কেটে গেলেও সুইমিংপুল আর নির্মাণ হয়নি।
‘আমাদের সময়ে সাঁতার কাটার অনেক জায়গা ছিল। সেগুলো এখন প্রায় হারিয়ে গেছে। বেড়ায় সুইমিংপুল নির্মাণ করা হলে সাঁতারের হারানো ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার সম্ভব বলে মনে করি।’মো. আবদুল হামিদ, জাতীয় সাঁতার দলের বর্তমান কোচ ও বাংলাদেশ সুইমিং ফেডারেশনের সহসভাপতি
বৃশালিখা মহল্লার খ্যাতিমান সাবেক সাঁতারুদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সত্তরের দশক থেকে শুরু করে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত ছিল মহল্লার সাঁতারুদের সোনালি সময়। ওই সময় দেশের বিভিন্ন প্রতিযোগিতার ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ পদক থাকত এই মহল্লার সাঁতারুদের দখলে। শুধু কৃতী সাঁতারু হওয়ার কারণে এই মহল্লার শতাধিক তরুণ-তরুণী সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনী ও প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেয়েছেন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রেও মহল্লার শিক্ষার্থীরা পেয়েছেন অগ্রাধিকার।
সোনালি সময়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পুরস্কার পেয়েছেন এ মহল্লার সাঁতারু দীন আমিন, মো. মনিরুজ্জামান, মিজানুর রহমান। এই মহল্লার পার্শ্ববর্তী দক্ষিপাড়া মহল্লার ইলিয়াস হোসেনও সাফ গেমসে পদক পেয়েছেন। প্রতিবছর জাতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতায় স্বর্ণ, রৌপ্য মিলিয়ে কয়েকটি করে পদক পেয়েছেন মহল্লার তরুণেরা। শাহজাহান আলী, আবদুল হামিদ, আলমগীর হোসেন, আমিনুল ইসলাম, আবদুল হালিম, লিয়াকত হোসেন, রত্না খাতুন, শারমিন আক্তার প্রমুখ জাতীয় ও বয়সভিত্তিক সাঁতারে একাধিক সোনা জিতেছেন।
জাতীয় সাঁতার দলের বর্তমান কোচ ও বাংলাদেশ সুইমিং ফেডারেশনের সহসভাপতি মো. আবদুল হামিদ বৃশালিখা মহল্লার কৃতী সাঁতারু। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের সময়ে সাঁতার কাটার অনেক জায়গা ছিল। সেগুলো এখন প্রায় হারিয়ে গেছে। বেড়ায় সুইমিংপুল নির্মাণ করা হলে সাঁতারের হারানো ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার সম্ভব বলে মনে করি।’
বৃশালিখাসহ বেড়া উপজেলায় প্রায় দুই দশক ধরে সাঁতারের সুদিন নেই। এই সময়ে তেমন কোনো কৃতী সাঁতারুর দেখা মেলেনি। সাবেক সাঁতারুরা জানিয়েছেন, আগে বৃশালিখা মহল্লাসহ বেড়া উপজেলার সাঁতারুরা ইছামতী নদীতে সাঁতার কেটে নিজেদের প্রস্তুত করতেন। কিন্তু উৎসমুখে বাঁধ দেওয়ায় বছর দশেক হলো নদীটি মরা খালে পরিণত হয়েছে। বেশ কয়েকটি পুকুর ভরাট করে ফেলায় সাঁতার চর্চার বেশির ভাগ উৎস বন্ধ হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে তিন মন্ত্রীসহ বেশ কয়েকজন জনপ্রতিনিধির প্রতিশ্রুতি দেওয়া সুইমিংপুলও নির্মাণ করা হয়নি।
বর্তমান সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে (১৯৯৬ থেকে ২০০১) বেড়ায় এক জনসভায় এসে সুইমিংপুল নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। ওই সময় তথ্য প্রতিমন্ত্রী ছিলেন বৃশালিখা মহল্লার আবু সাইয়িদ। তিনিও বিভিন্ন সমাবেশে দেওয়া বক্তৃতায় বেড়ায় সুইমিংপুল করার আশ্বাস দিয়েছিলেন। এ ছাড়া বর্তমান ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক ২০০৯ সালে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। তিনি নিজেও একজন কৃতী সাঁতারু। প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে তিনিও সুইমিংপুল নির্মাণের আশ্বাস দিয়েছিলেন।
বৃশালিখা মহল্লার আরেক কৃতী সাঁতারু শাহজাহান আলী বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক। হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে প্রায়ই তিনি বেড়ায় এসে শিশু–কিশোর সাঁতারুদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন।
শাহজাহান আলী বলেন, ঐতিহ্যগতভাবে এলাকার শিশু-কিশোরদের মধ্যে রয়েছে সাঁতারের প্রতি ব্যাপক আগ্রহ। কৃতী সাঁতারু গড়ে তোলার জন্য আধুনিক উপকরণসহ সুইমিংপুলের প্রয়োজন। এটা পেলে সাঁতারের হারানো ঐতিহ্য সহজেই ফিরিয়ে আনা সম্ভব।