১৪ বছর বয়সে সাম্পানের বইঠা হাতে নেন নাছির আহমদ। এখন বয়স সত্তরের কাছাকাছি। এ বয়সেও ছাড়তে পারেননি সাম্পান চালানো। কর্ণফুলীর প্রেমে জড়িয়ে যাওয়া জীবনে আর কোনো পেশা টানেনি তাঁকে। এ নদী দেখে দেখে, সাম্পানের সঙ্গেই বাকি জীবনটা কাটাতে চান তিনি।
নাছির আহমদ বলেন, ‘জীবন–যৌবন সবই কর্ণফুলীর জন্য দিয়ে দিলাম। সাম্পান চালানো বন্ধ করে দেখেছি। ঘরে থাকতে পারি না। অসুস্থ হয়ে পড়ি। তাই সাম্পানে ফিরে আসতে হয়। মনে হয় এখন ভালো আছি, সুস্থ আছি। তাই এ কাজ ছাড়ছি না।’
তিন যুগ ধরে বইঠা হাতে সাম্পান চালিয়েছেন নাছির। কিন্তু ২০ বছর ধরে ইঞ্জিনচালিত নৌকা চালান। এখন খরচাপাতি বাদ দিয়ে দিনে এক থেকে দেড় হাজার টাকা আয় হয়। এতেই চলে যায়। সাম্পান চালিয়ে দুই ছেলে ও চার মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। তাঁর ভাষায়, সহায়-সম্পদ বলতে যা হয়েছে, সবই কর্ণফুলীর দান।
শুধু নাছির আহমদই নন; কর্ণফুলী নদীর প্রেমে এক জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন অনেক সাম্পানচালক। তাঁদেরই একজন বয়োবৃদ্ধ সাম্পানচালক নুরুল আলম (৭৩)। তিনিও ৫০ বছর ধরে আছেন এই পেশায়। নুরুল আলম বলেন, ‘তখন দাঁড়টানা নৌকা ছিল। নৌকার গতিও ছিল বেশি। জনপ্রতি ভাড়া ছিল আট আনা। দিন শেষে ১০ থেকে ১৫ টাকা আয় হতো। সেই আয় দিয়েই সংসার চলেছে। আর অন্য কিছু করিনি।’
নুরুল আলম বলেন, ‘সাম্পান চালিয়ে তিন ছেলেকে মানুষ করেছি। এই নদী আমার সবকিছু। মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত নদীতে কাটাতে চাই।’
চট্টগ্রাম নগরের চর পাথরঘাটা ইউনিয়নে ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সরকার একটি ভাসমান সেতু তৈরি করেছিল। কর্ণফুলী নদীর উত্তর পাড়ের ফিরিঙ্গিবাজারের সঙ্গে ও কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ের চরপাথরঘাটাকে যুক্ত করেছিল ওই সেতু। ভাসমান ওই সেতু দিয়ে হেঁটেই কর্ণফুলী পারাপার করতেন দুই পারের মানুষ। ওই সময় থেকে দক্ষিণপাড়ের কর্ণফুলী ঘাট ব্রিজঘাট নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। ১৯৭০ সালের ঝড়ে সেতুটি বিধ্বস্ত হলেও ব্রিজঘাট নামটি রয়েছে আজও। এই ব্রিজঘাটে এলে এখনো সারি সারি সাম্পানের দেখা মেলে। কর্ণফুলীর ওপর দুটি সেতু তৈরি হলেও সাম্পানের গুরুত্ব কমেনি। চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষ এখনো সাম্পানের ওপর ভরসা করেন।
কর্ণফুলী নদীর কালুরঘাট থেকে শুরু করে ১৫ নম্বর সিইউএফএল ঘাট পর্যন্ত ১৬টি খেয়াঘাট আছে। এসব খেয়াঘাট থেকে নদীর দুই পাড়ে সাম্পান চলাচল করে। ঘাটের চালকদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে কর্ণফুলী নদী সাম্পান মাঝি কল্যাণ ফেডারেশন। আর এতে সদস্য হিসেবে আছেন তিন হাজারের বেশি। তবে ১৬টি খেয়াঘাটের মধ্যে নতুন ব্রিজঘাট, তোতার বাপের হাট, বিআইডব্লিউ ঘাট, দক্ষিণ পাড় পুরোনো ব্রিজঘাট, সদরঘাট, অভয় মিত্র ঘাট, কর্ণফুলী ঘাট, বাংলাবাজার ঘাট, সল্টগোলা ঘাটসহ ১০টি ঘাট দিয়ে সবচেয়ে বেশি যাত্রী পারাপার করেন। আর এসব ঘাটের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন সাম্পানচালকেরা।
কর্ণফুলীর ঘাট পার হয়ে নিয়মিত চট্টগ্রাম শহরে আসা-যাওয়া করেন বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা শারমিন মনি। তিনি নিয়মিত সাম্পানে করে কর্ণফুলী নদী পারাপার হন। এ এক অসাধারণ অনুভূতি।
চর পাথরঘাটা পুরোনো ব্রিজঘাটের সাম্পান চালক কল্যাণ সমিতির সভাপতি আবুল হোসেন বলেন, ‘আমাদের ঘাটটি সবচেয়ে ব্যস্ত। এ ঘাটে ২১৪ জন মাঝি যাত্রী পারাপারে ব্যস্ত থাকেন। ঘাট দিয়ে সাম্পানে করে পার হন চাকরিজীবী, শত শত শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন শ্রেণির প্রায় ১০ হাজার যাত্রী।’
কর্ণফুলী নদী সাম্পান মাঝি কল্যাণ ফেডারেশনের সভাপতি এস এম পেয়ার আলীর কথা দিয়ে শেষ করা যাক। তাঁর মতে, সাম্পান চালানো পেশার চেয়েও বেশি কিছু। এ নদী সাম্পানচালকদের প্রেম-ভালোবাসা। নদী আর সাম্পান–মাঝির জীবন একাকার।