সব হারিয়ে কোথায় যাবেন অন্তঃসত্ত্বা ছেনোয়ারা

চট্টগ্রাম নগরের কালুরঘাট মৌলভি বাজার এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের পর ধ্বংসস্তূপে নিজেদের হারানো জিনিসপত্র খুঁজছেন ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন। গতকাল বিকেল ৩টায়
ছবি-সৌরভ দাশ

৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছেনোয়ারা বেগমের প্রসবের সম্ভাব্য তারিখ পড়েছে ২৯ অক্টোবর। চিকিৎসকের পরামর্শে শেষ সময়ে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। স্বামী অল্প অল্প করে জমিয়েছিলেন ২৫ হাজার টাকা। গতকাল সোমবার দুপুরে তাঁর ছোট্ট কাঁচা ঘরের সবকিছু আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। টাকাপয়সা, পরনের কাপড়, সোনার এক জোড়া কানের দুল—কিছুই বের করে আনতে পারেননি।

ছাইয়ের ভেতর থেকে জমানো টাকা খুঁজতে খুঁজতে ছেনোয়ারা বেগম কান্নায় ভেঙে পড়েন। ভাঙা স্বরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সবকিছু শেষ হয়ে গেল। ঘর থেকে কিছুই বের করে আনতে পারলাম না। আমার প্রসবের দিনে চিকিৎসা জন্য টাকা জমিয়েছিলাম। সব ছাই হয়ে গেছে।’

পঁচিশোর্ধ্ব ছেনোয়ারার সঙ্গে কথা হয় গতকাল বেলা সাড়ে তিনটার দিকে। চট্টগ্রাম নগরের কালুরঘাটের মৌলভীবাজার এলাকার রেললাইনের পাশের একটি বস্তিতে ভাড়া থাকতেন তিনি। গতকাল বেলা দেড়টার দিকে বস্তির একটি ঘরে আগুন লাগে। আগুন ছড়িয়ে পড়ায় এক ঘণ্টার মধ্যেই পুড়ে যায় ৮২টি ঘর। এতে ছেনোয়ারার মতো আরও ৫৪টি পরিবার মুহূর্তেই মাথা গোঁজার ঠাঁই হারায়। পরে ফায়ার সার্ভিসের চারটি ইউনিট গিয়ে আগুন নেভায়।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কালুরঘাট স্টেশনের জ্যেষ্ঠ স্টেশন কর্মকর্তা মোহাম্মদ বাহার উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকেই আগুনের সূত্রপাত বলে ধারণা করা হচ্ছে। হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। চারটি ইউনিট এক ঘণ্টার মধ্যেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।

হঠাৎ আগুন আগুন বলে শোরগোল

অগ্নিকাণ্ডে সব হারিয়ে আহাজারি করছেন সুফিয়া বেগম নামের এক নারী। গতকাল বিকেল ৩টায়

ছেনোয়ারার স্বামী ইমাম হোসেন এলাকায় একটি কমিউনিটি সেন্টারে কাজ করেন। মাসে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা আয়। তাঁর একার আয়েই চলে চার সদস্যের সংসার। তাঁদের এক ছেলে ও এক মেয়ে। প্রতিদিনের মতো গতকাল সকালে কর্মস্থলে চলে গিয়েছিলেন ইমাম। আগুন লাগার খবর পেয়ে ফিরে আসেন তিনি। ইমাম বলেন, ‘দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছিল। ঘরে ঢোকার সুযোগ ছিল না। এখন প্রসবের জন্য হাসপাতালে যে টাকা লাগবে, তা-ও নেই। কী করব, কিছুই বুঝতে পারছি না।’

চোখ মুছতে মুছতে ছেনোয়ারা বলেন, তিনি রান্না করছিলেন। হঠাৎ চারদিকে শোরগোল লেগে যায়। আগুন আগুন বলে সবাই চিৎকার করতে থাকেন। তিনি ছেলেমেয়েকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে যান। টাকাটা বের করার কথা মাথায় আসেনি।

রেলওয়ের জায়গা ইজারা নিয়ে গড়ে উঠেছিল বস্তিটি। হাজি আহম্মদ কলোনি ও মামুন কলোনি নামে এলাকায় বস্তিটি পরিচিত ছিল। মামুন কলোনিতে ঘর ছিল ৬৬টি। এর মধ্যে ৩৮টি ঘরে ভাড়াটেরা থাকতেন। অন্যদিকে হাজি আহম্মদ কলোনিতে ঘর ছিল ৩০টি। এর মধ্যে ১৬টি ঘর আগুনে পুড়েছে। এসব ঘরে থাকতেন পোশাকশ্রমিক, রিকশাচালক, ভিক্ষুকসহ নানা পেশার মানুষ।

ওই বস্তিতে গিয়ে দেখা যায়, ৮ ফুট বাই ১০ ফুটের একেকটি ঘর। ঘরের পোড়া টিনগুলো স্তূপ হয়ে পড়ে আছে মেঝেতে। জিনিসপত্র সব ছাই হয়ে গেছে। ঘরের চৌকি পুড়ে কয়লা হয়ে পড়ে আছে। এসবের ভেতর মনোযোগ দিয়ে কী যেন খুঁজছিলেন সুমি আক্তার। বয়স তাঁর ছাব্বিশের কাছাকাছি। কাছে গিয়ে কথা হয় চার সন্তানের এ মায়ের সঙ্গে।

তিনি একটা বই হাতে নিয়ে বলেন, ‘ছোট মেয়ে রেশমি আক্তার ক্লাস ওয়ানে পড়ে। বইটা কয়েক দিন আগেই তাকে কিনে দিয়েছিলাম। পাতাগুলো সব পুড়ে গেছে। ঘরের কিছুই নেই। কোথায় যাব, কী করব, কিছুই জানি না।’

সুমি আক্তারের স্বামী মো. শাহদুল্লাহ পেশায় ট্রাকচালক। মাসে ১৬ হাজার টাকা বেতন পান। এই টাকায় কোনোরকমে টেনেটুনে সংসারটা চলে। শাহদুল্লাহ বলেন, পাশাপাশি দুটি ঘর ভাড়া নিয়ে তাঁরা থাকতেন। ভাড়া পড়ত চার হাজার টাকা। আগুন তাঁদের পথে বসাল। এখন খাবারের টাকাটাও নেই। সবকিছু আবার কীভাবে শুরু করবেন, তা ভেবে কূল পাচ্ছেন না।

বস্তির পাশের রেললাইনের ওপর বসে গগনবিদারী আর্তনাদ করছিলেন চল্লিশোর্ধ্ব সুফিয়া বেগম। এলাকার বাজারে দিনমজুরের কাজ করেন তিনি। আহাজারি করতে করতে বলছিলেন, স্বামী–সন্তান সবাই চলে গেছে। ঘরটাতে কোনোরকমে থাকতেন। ঘরটাও নাই হয়ে গেল। এখন খোলা আকাশের নিচে থাকা ছাড়া বিকল্প নেই।

এক সন্তান ও স্বামীকে নিয়ে বস্তিতে ভাড়া থাকতেন রুনা আকতার। তিনি জুতা রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ম্যাফ সুজ লিমিটেডের কর্মী। গতকাল বিকেলের পালায় তাঁর চাকরি ছিল। কিন্তু যেতে পারেননি। রুনা বলেন, আগুন লাগার পর বাইরে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন। চোখের সামনে সব পুড়েছে। কিন্তু কিছুই করার ছিল না।

মামুন কলোনির স্বত্বাধিকারী সুলতান আহমেদ ওরফে মামুন প্রথম আলোকে বলেন, রেলওয়ের জায়গা ইজারা নিয়ে ঘর তুলেছিলেন। নিম্ন আয়ের মানুষেরা ভাড়া থাকতেন। সবাই পথে বসেছেন।