দূষণের মুখে শান্ত পারুলি

পারুলি নদী এত দিন শিল্পাঞ্চলের দূষণের বাইরে ছিল। একটি প্রতিষ্ঠানের মুরগির বর্জ্যের কারণে এ জলাশয় দূষণের কবলে পড়তে যাচ্ছে।

মিঠাপানির আধার হিসেবে পরিচিত পারুলি নদী। এ নদীতে মুরগির বিষ্ঠা ও বর্জ্য ফেলে দূষিত করতে যাচ্ছে একটি প্রতিষ্ঠান। সম্প্রতি গাজীপুরের শ্রীপুরের বাউনি এলাকায়

প্রতিদিন সাড়ে চার লাখের বেশি মুরগির বিষ্ঠা ও বর্জ্যে ফসলের ক্ষতি হচ্ছিল তিন বছর ধরে। কৃষকদের লাগাতার প্রতিবাদের মুখে সেই ক্ষতিকর বর্জ্য প্রাকৃতিক খাল হয়ে নদীতে ফেলার ব্যবস্থা করছে একটি প্রতিষ্ঠান। এতে নতুন করে দূষণের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে মিঠাপানির আধার হিসেবে পরিচিত পারুলি নদী। প্যারাগন অ্যাগ্রো লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের কারণে দূষণের কবলে পড়তে যাচ্ছে নদীটি।

নদী ও প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান গাজীপুরের শ্রীপুরের বাউনি গ্রামে। গত সোমবার ওই গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি গ্রাম ধরে যাওয়া সেরার খালের সঙ্গে বর্জ্যের স্থায়ী ট্যাংকের সংযোগ স্থাপনের জন্য খননকাজ চালাচ্ছে। খালটি পারুলি নদীর সঙ্গে যুক্ত। প্রায় এক কিলোমিটারজুড়ে স্থাপন করা হচ্ছে পাইপলাইন। এই দৈর্ঘ্যের প্রায় অর্ধেকজুড়ে আছে বন বিভাগের জমি।

স্থানীয় লোকজন জানান, সেরার খাল ও পারুলি নদী এত দিন শিল্পাঞ্চলের দূষণের বাইরে ছিল। প্যারাগন অ্যাগ্রোর বর্জ্যের দুর্গন্ধে আশপাশের এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ। বিষয়টি প্যারাগন অ্যাগ্রোকে বারবার জানালেও এলাকাবাসীর কথায় কর্ণপাত করছে না তারা। বর্জ্য পাশের পারুলি নদীতে পড়লে নদী ও খালের মাছ ও জীববৈচিত্র্য সংকটে পড়বে।

প্যারাগন অ্যাগ্রো লিমিটেডের প্রশাসন বিভাগের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা অধীত রায় চৌধুরী গতকাল সোমবার দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা মুরগির বিষ্ঠার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কম্পোস্ট সার তৈরি করেন। কিছু তরল কারখানার পেছন দিকের একটি নির্দিষ্ট জায়গায় জমা হয়। বৃষ্টি হলে সেটি উপচে অনেকের ফসলের ক্ষতি হয়। মানুষের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে ওই পানি পাশের খালে ফেলা হবে। বড় কালভার্টের মাধ্যমে আশপাশে পানি ছড়িয়ে যাওয়া রোধ করা হবে। এই বর্জ্য খাল ও নদীর জলজ প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ইটিপির মাধ্যমে তরল পরিশোধন করার ব্যবস্থা করা হবে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য, তিন-চার বছর ধরে পোলট্রি বর্জ্যের কারণে ২০ থেকে ২৫ জন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। জমিতে কোনো ফসল ফলাতে পারছেন না তাঁরা। গ্রামের বাসিন্দা জোহরা বেগম বলেন, পোলট্রির ময়লা ফেললে দুর্গন্ধে এলাকায় টেকা যায় না। পাইপলাইন করার জন্য তিনি তাঁর জমিতে খনন করতে দেবেন না বলে জানান।

পারুলি নদীপারের বাসিন্দা ফজলুল হক প্রথম আলোকে বলেন, শ্রীপুরের শিল্পবর্জ্য থেকে পারুলি নদীটি এত দিন সুরক্ষিত ছিল। কিন্তু এই নদীকেও মেরে ফেলার সব আয়োজন চলছে। নদীর সঙ্গে অসংখ্য মানুষের জীবিকায়ও প্রভাব ফেলবে এই পোলট্রি বর্জ্য। পোলট্রি খামারটির পাশের বাসিন্দা শিরু মিয়া জানান, পোলট্রি বর্জ্যের কারণে তাঁদের প্রচুর ফসল নষ্ট হচ্ছে। দুর্গন্ধে আশপাশের অনেক মানুষ অসুস্থ হচ্ছেন।

প্যারাগন অ্যাগ্রো কর্তৃপক্ষের দাবি এলাকাবাসীর সম্মতিতেই বর্জ্য অপসারণে পাইপলাইন স্থাপন করা হচ্ছে। প্রথম আলোকে প্রতিষ্ঠানটির গুদাম কর্মকর্তা শাহিন সরকার বলেন, স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে চুক্তি করে সেখানে কালভার্ট স্থাপন করা হচ্ছে। কালভার্ট স্থাপনের মাঝখানে বন বিভাগের জমি থাকলে সেখানে বড়সড় নালা কাটা হবে। ইতিমধ্যে জমির মালিকদের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে।

পরিবেশবাদী সংগঠন ‘নদী পরিব্রাজক দল’ শ্রীপুর শাখার সভাপতি সাঈদ চৌধুরী বলেন, শ্রীপুরের সেরার খালটি এখনো পুরোপুরি দূষণমুক্ত। এ খালটিতে কোনো অপরিশোধিত তরল বা সলিড বর্জ্য যাতে কেউ না ফেলতে পারেন, এ বিষয়ে এখনই উদ্যোগী হতে হবে। একই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক খুরশেদ আলম বলেন, ‘আমরা জলাশয়কে দূষিত হতে দেব না।’

বর্জ্য অপসারণের কালভার্ট স্থাপন কার্যক্রম পরিদর্শন করেছেন শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ওই প্রতিষ্ঠানকে তাঁদের প্ল্যান দেখাতে বলেছি। কোনোক্রমেই নদী ও খালের মধ্যে এমনকি বন বিভাগের জমির মধ্য দিয়ে এসব বর্জ্য অপসারণের লাইন স্থাপন করতে দেওয়া হবে না। যদি তারা খাল বা নদীতে বর্জ্য ফেলে, তাহলে আমরা আইনি ব্যবস্থা নেব।’

বন বিভাগের জমির ভেতর দিয়ে নালা তৈরি করতে দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন বন বিভাগের শ্রীপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা বজলুর রহমান। এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর গাজীপুর কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মইনুল হক প্রথম আলোকে বলেন, খাল বা নদীতে কোনো ধরনের বর্জ্য অপসারণের সুযোগ নেই। এ ধরনের কাজ অবৈধ।