শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হওয়ায় কক্সবাজারে ভিড় করছেন পর্যটকেরা। সমুদ্রসৈকতে এখন পর্যটকের ঢল নেমেছে। শহরের পাঁচ শতাধিক হোটেল-মোটেলের কোথাও কোনো খালি কক্ষ নেই।
সমুদ্র সৈকত ছাড়াও কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ, দরিয়ানগর পর্যটন পল্লি, হিমছড়ির ঝরনা, পাথুরে সৈকত ইনানী-পাটুয়ারটেক, টেকনাফ সমুদ্রসৈকত, ঐতিহাসিক প্রেমের নিদর্শন মাথিন কূপ, নেচার পার্ক, ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক, রামুর বৌদ্ধ পল্লিসহ বিনোদন কেন্দ্রগুলো এখন জমজমাট।
হোটেল ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগামী ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত পর্যটকের এই সমাগম লেগে লাগবে। ২১ ডিসেম্বর থেকে পাঁচ দিন পর্যটক কিছুটা কমে দৈনিক ৬০-৭০ হাজারে নেমে আসবে। ২৫ ডিসেম্বর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬ দিন দৈনিক এক লাখের বেশি পর্যটকের সমাগম ঘটবে। ওই সময়ে জন্য ইতিমধ্যে ৯০ শতাংশ হোটেল কক্ষ অগ্রিম বুকিং হয়ে গেছে।
হোটেল মালিকেরা জানান, গত বৃহস্পতিবার সৈকত ভ্রমণে এসেছেন ১ লাখ ১২ হাজার পর্যটক, শুক্রবার এসেছেন ১ লাখ ৪৮ হাজার, শনিবার এসেছেন আরও ১ লাখ। আজ রোববার বেলা দুইটা পর্যন্ত গত চার দিনে কক্সবাজার ভ্রমণ করেন অন্তত চার লাখ পর্যটক। সব মিলিয়ে আগামী ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচ দিনে সৈকত ভ্রমণে আসবেন আরও অন্তত পাঁচ লাখ পর্যটক। বিপুলসংখ্যক পর্যটকের নিরাপত্তা, সড়কের যানজট নিয়ন্ত্রণ এবং শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় হিমশিম খাচ্ছে টুরিস্ট ও ট্রাফিক পুলিশ।
দেখা গেছে, অনেকে হোটেল কক্ষ না পেয়ে বিভিন্ন পরিবহন সংস্থার টিকিট কাউন্টার, হোটেলের রিসেপশন, সঙ্গে নিয়ে আসা বাসে বিশ্রাম নিচ্ছেন। এ কারণে পর্যটকদের ছুটির সময় অনলাইনে হোটেল কক্ষ অগ্রিম বুকিং দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন কক্সবাজার হোটেল গেস্টহাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শহরের পাঁচ শতাধিক হোটেল মোটেল রিসোর্ট ও কটেজের কোনো কক্ষ এখন খালি নেই। আগে কক্ষ ভাড়ার বিপরীতে ২০-৩০ শতাংশের যে বিশেষ ছাড় দেওয়া হতো, তাও গত বৃহস্পতিবার থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এ সময় অগ্রিম কক্ষ ভাড়া না নিয়ে ভ্রমণে এলে বিপত্তিতে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
জমজমাট সৈকত
আজ রোববার সকাল সাতটায় কলাতলী সৈকতে গিয়ে দেখা গেছে, ঘন কুয়াশার মধ্যেও সৈকতে প্রচুর মানুষ। বেলা ১১টার সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টের এক কিলোমিটার লম্বা সৈকতে অন্তত ৫০ হাজার মানুষের ভিড় দেখা গেছে। শীত উপেক্ষা করে অনেকে সমুদ্রস্নানে নেমেছেন। কেউ দ্রুতগতির জলযান জেট স্কি নিয়ে গভীর সমুদ্র ঘুরে আসছেন। কেউ বালুচরে ঘোড়ার পিঠে চড়ে কিংবা বিচ বাইকে উঠে সৈকতের এপ্রাপ্ত থেকে ও প্রান্ত চক্কর মেরে আসছেন। পর্যটকদের সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব তৎপর দেখা গেছে টুরিস্ট পুলিশের সদস্যদের। গোসলে নেমে ঢেউয়ের ধাক্কায় কিংবা স্রোতের টানে কেউ ভেসে গেলে উদ্ধার তৎপরতার চালাচ্ছেন লাইফগার্ড কর্মীরা।
দুপুরে সুগন্ধা পয়েন্টে কথা হয় ঢাকার ফরাসগঞ্জের ব্যবসায়ী আবুল কালামের সঙ্গে। স্ত্রী, তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে গত শুক্রবার দুপুরে কক্সবাজার পৌঁছান। আবুল কালাম (৪৮) বলেন, ‘সৈকতে মানুষের ঢল দেখে অবাক হয়ে গেলাম। অগ্রিম হোটেল কক্ষ বুকিং না দিয়ে এলে বিপদে পড়তাম। এখন তিন চার গুণ বেশি ভাড়া দিয়েও অনেকে কক্ষ ভাড়া পাচ্ছেন না।’
সাভারের আজিমুল হক (৩৮) বলেন, পর্যটকের উপচে পড়া ভিড়ের কারণে হোটেল কক্ষ ভাড়া অতিরিক্ত হারে আদায় হচ্ছে। কোনো ছাড় পাওয়া যাচ্ছে না। রেস্তোরাঁয় খাবারের দামও অত্যধিক। অতিরিক্ত যানবাহনের চাপে হাঁটাচলাও করা যাচ্ছে না।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতির কারণে নিরাপত্তা ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌপথে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদীর নুনিয়াছটা বিআইডব্লিউটিএ-জেটি ঘাট থেকে একাধিক জাহাজে দৈনিক দুই হাজার পর্যটকের সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ভ্রমণে যাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে অনলাইন নিবন্ধন সম্পন্ন করে ভ্রমণ পাস নিশ্চিত করতে হয়।
টুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এক সঙ্গে কয়েক লাখ পর্যটকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে টুরিস্ট পুলিশের ৮৫ জন সদস্যকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আজ দুপুর পর্যন্ত কোনো পর্যটক হয়রানি কিংবা দুর্ঘটনার কবলে পড়েননি।
জেলা ট্রাফিক পুলিশের প্রধান ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জসিম উদ্দিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, পর্যটকবাহী অন্তত ৭ হাজার যানবাহন (বাস, মাইক্রো, কার-জিপ) শহরে অবস্থান করায় কলাতলী ডলফিন মোড়, বাইপাস সড়ক, প্রধান সড়কের বাজারঘাটাতে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। যানজট নিরসনে কাজ করছেন ৬০ জন পুলিশ।
খালি নেই হোটেল রিসোর্টের কক্ষ
সৈকতের কলাতলীতে ছয়তলার ওয়েল পার্ক গেস্টহাউসে কক্ষ আছে ৪৪ টি। আজ সকালে সকালে গিয়ে দেখা গেল, কোনো কক্ষ খালি নেই। গেস্টহাউসটির ব্যবস্থাপক মো. ইউনুস বলেন, আগামী ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত সব বুকিং হয়ে গেছে। শতাধিক পর্যটক কক্ষ ভাড়া না পেয়ে ফিরে গেছেন। তারকা হোটেল কক্স-টু ডে-তেও কোনো কক্ষ খালি নেই জানিয়ে ব্যবস্থাপক আবু তালেব বলেন, এই অবস্থা আরও সাত-আট দিন থাকবে। লাবনী পয়েন্টের কলাতলীর সি পার্ক গেস্টহাউস, অস্টার ইকো, ইউনি রিসোর্ট, ডায়মন্ড প্যালেস, সেন্ট মার্টিন রিসোর্ট, ইকরা বিচ রিসোর্ট, মিডিয়া ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল কল্লোল, অভিসার, তারকা হোটেল সি গাল, সায়মান বিচ রিসোর্ট, কক্স টু ডে, লং বিচ হোটেল, ওশান প্যারাডাইসসহ ছোট-বড় পাঁচ শতাধিক হোটেল, মোটেল, গেস্টহাউস, রিসোর্ট ও কটেজের অধিকাংশ কক্ষ খালি নেই। এসব হোটেলে কক্ষ আছে ৮৪ হাজারের বেশি। ধারণক্ষমতা ১ লাখ ২৮ হাজার। গাদাগাদি করে থাকলে সর্বোচ্চ ২ লাখ ১০ হাজার পর্যটক থাকা যায়।
কক্সবাজার হোটেল রিসোর্ট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুকিম খান বলেন, ১৬ ডিসেম্বরের পর কক্ষভাড়ার বিপরীতে কোনো ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। যদিও নভেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ছাড় দেওয়া হয়েছিল সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ।
অতিরিক্ত পর্যটকের ভিড়ের সুযোগে হোটেল কক্ষের ভাড়া ও রেস্তোরাঁগুলোতে খাবারের দাম বেশি আদায় করা হচ্ছে কি না, তা তদারকির জন্য প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে একাধিক ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঠে নামানো হয়েছে বলে জানান জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, পর্যটকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত কক্ষভাড়া কিংবা খাবারের মূল্য আদায়ের অভিযোগ প্রমাণিত হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।