নিক্সনে বিলীন অধিকাংশ নেতা

অনেকে ক্ষমতার স্বাদ পেতে, অনেকে নির্যাতনের ভয়ে, অনেকে ব্যবসা-বাণিজ্য ঠিকমতো করার আশায় দল ত্যাগ করেছেন।

খন্দকার ইকবাল হোসেন ও শাহরিয়ার ইসলাম

ফরিদপুরের ভাঙ্গায় বরাবরই দুর্বল বিএনপি। একক কোনো নেতৃত্ব না থাকায় আওয়ামী লীগের সামনে দাঁড়ানোর সক্ষমতা খুব কমই দেখাতে পেরেছে দলটি। এ কারণে দলীয় কর্মকাণ্ড হয়ে পড়েছে কেবল নির্বাচন এলে নৌকার বিরোধিতাকেন্দ্রিক। এ জন্য দলীয় প্রার্থীকে ভোট না দিয়ে নৌকাকে ঠেকাতে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মজিবুর রহমান চৌধুরী ওরফে নিক্সনের শিবিরে ভেড়েন বিএনপির সমর্থকেরা। এভাবেই নিক্সনে বিলীন হয়ে গেছেন বিএনপির চলমান কমিটির অধিকাংশ সদস্য। 

উপজেলা বিএনপির সর্বশেষ কমিটি হয় ২০১৫ সালের ১০ অক্টোবর। ১০১ সদস্যবিশিষ্ট এই কমিটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে ২০১৮ সালে। গত ২৬ জানুয়ারি ভাঙ্গা পৌরসভার ১২ সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি অনুমোদন দেয় জেলা বিএনপি। এতে আহ্বায়ক হন মিজানুর রহমান ও সদস্যসচিব মুন্সী মনিরুজ্জামান। এ নিয়ে প্রতিবাদ হলে গত ২৯ জানুয়ারি কেন্দ্র থেকে কমিটি স্থগিত করা হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে উপজেলা বিএনপির এক নেতা বলেন, ঘোষিত পৌর কমিটি ভালোই হয়েছিল। কিন্তু লিডার টু লিডার দ্বন্দ্ব থাকায় ওই কমিটি স্থগিত করা হয়েছে।

ভাঙ্গায় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত তিনজন নেতা জানান, বর্তমানে বিএনপির কার্যক্রম স্থবির হয়ে আছে। এ স্থবিরতা বোঝাতে একটি উদাহরণই যথেষ্ট। সেটা হলো গত সাত বছরে উপজেলা বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে গায়েবি কিংবা হয়রানিমূলক মামলা হয়নি। ঘটেনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংঘর্ষের কোনো ঘটনা।

ভাঙ্গায় বিএনপির ভোট আছে ২৫ থেকে ৩০ হাজার। এরপরও নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের এত কম ভোট পাওয়ার কারণ, নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন কারণে অন্যমুখী। বর্তমানে শুধু আদর্শ দিয়ে কর্মীদের ধরে রাখা যায় না।
আইয়ুব মোল্লা, সাংগঠনিক সম্পাদক, ভাঙ্গা উপজেলা বিএনপি

আশাপ্রদ নয় নির্বাচনী ফলাফল

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভাঙ্গা ফরিদপুর-৪ আসনের অন্তর্গত। ভাঙ্গা, চরভদ্রাসন এবং কৃষ্ণপুর ইউনিয়ন ব্যতীত সদরপুর উপজেলা নিয়ে এই আসনের সীমা। তবে সীমানা পুনর্গঠনের আগ পর্যন্ত শুধু ভাঙ্গা উপজেলা নিয়ে ফরিদপুর-৫ আসন ছিল। ১৯৯১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত জাতীয় সংসদের সাতটি নির্বাচনের মধ্যে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির একতরফা নির্বাচনে এ আসন থেকে নির্বাচিত হন বিএনপির ছরোয়ার জান মিয়া। তিনি জেলা বিএনপির সভাপতি ছিলেন। বাকি ছয়টি নির্বাচনে বিএনপি জিততে তো পারেইনি, ভোটের হারও ছিল অত্যন্ত কম।

উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আইয়ুব মোল্লা বলেন, ভাঙ্গায় বিএনপির ভোট ২৫ থেকে ৩০ হাজার। এরপরও নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের এত কম ভোট পাওয়ার কারণ, নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন কারণে অন্যমুখী। বর্তমানে শুধু আদর্শ দিয়ে কর্মীদের ধরে রাখা যায় না। জনবল ধরে রাখতে হলে রসদ প্রয়োজন।

নিক্সনে বিলীন দলের একাংশ

২০১৫ সালে ১০১ সদস্য বিশিষ্ট উপজেলা বিএনপির অন্তত ৫০ শতাংশ নেতা বর্তমান ফরিদপুর-৪ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মজিবুর রহমান চৌধুরী ওরফে নিক্সনের শিবিরে যোগ দিয়েছিলেন। এ হিসাব দিয়েছেন উপজেলা বিএনপির নেতারাই। এর মধ্যে ছিলেন উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি চান্দ্রা ইউপির বর্তমান চেয়ারম্যান আবদুল খালেক মোল্লা, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বেল্লাল হোসেন ও জাহাঙ্গীর হোসেন, পৌর বিএনপির সভাপতি আবু জাফর মুন্সী, ঘারুয়া ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি বাকি খলিফা, চান্দ্রা ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি গিয়াসউদ্দিন আলী প্রমুখ।

এ বিষয়ে নেতাদের অভিমত, ভাঙ্গায় যেহেতু বিএনপি দুর্বল, সাংগঠনিক তৎপরতা নেই, তাই নিক্সনের সঙ্গে থেকে ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া যাচ্ছে। পাশাপাশি নৌকার বিরোধিতাও করা যাচ্ছে।

তবে নিক্সনের সঙ্গে হাত মেলানো নেতারা এ বক্তব্য মানতে নারাজ। তাঁদের একজন আব্দুল খালেক মোল্লা বলেন, ‘নিক্সনের কর্মকাণ্ড দেখে আকৃষ্ট হয়েছি। তিনি মানুষ হিসেবে উদার, আকর্ষণীয় ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। এ জন্য আমি তাঁর সঙ্গে হাতে মিলিয়েছি।’

উপজেলা বিএনপির সভাপতি খন্দকার ইকবাল হোসেন বলেন, ‘নির্যাতনের ভয় তো আছেই, পাশাপাশি তাঁরা ব্যবসা-বাণিজ্য ঠিকমতো করতে পারছেন। এটাও দল ত্যাগের একটি কারণ।’

এর মধ্যেও আছে দ্বন্দ্ব

অস্তিত্ব সংকটাপন্ন হলেও অন্যান্য উপজেলার মতো ভাঙ্গাতেও বিএনপির নেতৃত্বের মধ্যে রয়েছে আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্ব। একটি ধারার নেতৃত্ব দেন উপজেলা বিএনপির সভাপতি খন্দকার ইকবাল হোসেন। অপর ধারাটির নেতৃত্ব দেন জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতি সংস্থা (জাসাস) কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি ভাঙ্গার চান্দ্রা ইউনিয়নের পাঁচকুল গ্রামের মেয়ে শাহরিয়ার ইসলাম ওরফে শায়লা।

২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে শাহরিয়ার মনোনয়ন চেয়েছিলেন। তবে মনোনয়ন পান ইকবাল হোসেন। দ্বিধাবিভক্ত জেলা বিএনপির একটি অংশ শাহরিয়ার ইসলামকে দিয়ে এ দ্বন্দ্ব জিইয়ে রাখার জন্য মদদ দিচ্ছেন বলে অভিমত রয়েছে উপজেলা বিএনপির নেতাদের মধ্যে।

খন্দকার ইকবাল হোসেন বলেন, ‘উপজেলা বিএনপিকে আমি সংগঠিত করছি।। তিনি তো (শাহরিয়ার ইসলাম) বিদেশে থাকেন। বিদেশে থেকে ফোনে ফোনে কি আর দল করা যায়!’

শাহরিয়ার ইসলাম বিদেশে থাকায় এ ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে তাঁর অনুসারী স্থগিত হওয়া ভাঙ্গা পৌর বিএনপির আহ্বায়ক  মিজানুর রহমান বলেন, ‘খন্দকার ইকবাল হোসেন আগে ছাত্রলীগ করতেন। তিনি ২০১৪ সালে বিএনপিতে যোগ দেন। তিনি বিএনপির মূলধারা হতে পারেন না। তাঁর হাতে বিএনপির রাজনীতি নিরাপদ নয়।’

ভাঙ্গা ছাত্রদলের আহ্বায়ক সানজিদ ফেরদৌস বলেন, ‘শাহরিয়ার ইসলাম গত প্রায় এক বছর ধরে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। তিনি সেখানে একটি ডিগ্রি লাভের জন্য পড়াশোনা করছেন। আগামী ঈদের পরে তার দেশে ফেরার কথা।’