চুলায় গনগনে কাঠের আগুনের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছে। সেখানে বসানো বিশাল কড়াইয়ে চিনির রসের মধ্যে ছোট্ট গোল গোল গোল্লা সেদ্ধ হচ্ছে। বিশাল চামচ নিয়ে সেগুলো অতি সাবধানে নাড়াচাড়া করছেন একজন। চুলা থেকে নামিয়ে ঠান্ডা করার পর শিরা থেকে তোলা হচ্ছে মিষ্টিগুলো। এরপর সেগুলো চিনির ওপর গড়ানোয় তৈরি হচ্ছে দানাদার।
গভীর মনোযোগে কাজটি করছিলেন বিকাশ ঘোষ। ষাটের কাছাকাছি বয়সী মানুষটি অর্ধশতাব্দী ধরেই মিষ্টি তৈরির কাজ করেন। আর বিভিন্ন পালাপার্বণে গ্রামে গ্রামে যে মেলা হয়, এসব মিষ্টি সেখানে বিক্রি করেন। বাবা কালীপদ ঘোষ আর ঠাকুরদাদা মাতঙ্গী ঘোষের হাত ধরে বংশপরম্পরার এই ব্যবসায় এসেছেন তিনি। মেলার মৌসুম শেষে চলে বাড়ির জমিজমা দেখাশোনার কাজ।
খুলনা নগরের মুজগুন্নী ঈদ মেলায় মিষ্টির অস্থায়ী দোকানে বসে কথা হচ্ছিল বিকাশ ঘোষের সঙ্গে। ১৫ বছর ধরে মুজগুন্নীর ঈদ মেলায় দোকান দেন তিনি। ছয় দিনের এই ঈদ মেলা জমেও উঠেছে। শয়ে শয়ে মানুষ মেলায় ভিড় করছেন। নাগরদোলা, বায়োস্কোপসহ নানা আয়োজন আছে মেলায়।
সাতক্ষীরার তালা উপজেলার পাটকেলঘাটা গ্রাম থেকে ঈদের এক দিন আগে মেলায় এসেছেন বিকাশরা। তাঁদের দলে এবার আটজন। মেলার মাঠের অস্থায়ী দোকানে মিষ্টি তৈরি, বেচাবিক্রির পাশাপাশি থাকা-খাওয়াও চলে একই জায়গায়। আর দানাদার, গজা, রসগোল্লা, পানতুয়া, কোলবালিশ মিষ্টি—এসব চালু আইটেমই বেশি তৈরি করেন মেলায়। এসব মিষ্টি মেলার অন্যতম অনুষঙ্গ।
মূলত মাঘের শুরু থেকে বৈশাখের শেষ পর্যন্ত মেলার মৌসুম। দেশের নানা প্রান্তে এ সময় ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের মেলার আয়োজন করা হয়। আর এই সময়ে মেলা থেকে মেলায় গিয়ে মিষ্টির পসরা সাজিয়ে জমিয়ে তোলেন বিকাশের মতো মিষ্টির দোকানিরা।
আলাপে আলাপে জানা গেল, বিকাশরা সাতক্ষীরার নলতা ওরস শরিফ, বুধহাটার গুনারাকাটি পীর সাহেবের বাড়ির মাহফিল, বরিশালের চরমোনাই মাহফিল, যশোরের কেশবপুরের সাগরদাঁড়ির মধুমেলা, খুলনার মুজগুন্নীর দুই ঈদের সময়ের মেলার মতো কাছে-দূরের বড় বড় মেলায় যেমন যান, তেমনি পসরা সাজান গ্রামের ছোট মেলাতেও। মেলার আয়োজন ও পরিসর অনুসারে বাড়ে-কমে মিষ্টি তৈরির কর্মীর সংখ্যা। কখনো দলে থাকেন ১৪-১৫ জন, কখনো আবার ২ জনই সামলে নেন। কর্মীদের কাজ অনুযায়ী দৈনিক বেতন ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা হয়। আর মেলা অনুসারে প্রতিদিন ৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকার মিষ্টি বিক্রি হয়ে থাকে।
বিকাশ ঘোষ বলছিলেন, আগের চেয়ে সব জায়গা উন্নত হয়েছে। মেলার পরিসর বেড়েছে। মানুষের আনাগোনাও আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি। আগে এত কায়দাকানুন ছিল না। মেলায় খরচ তেমন ছিল না। তবে এখন খরচ বেড়েছে।
উদাহরণ টেনে বিকাশের বড় ভাই বিধান ঘোষ বলছিলেন, ‘সাগরদাঁড়ির মেলায় একসময় ২০০ টাকা দিয়ে অংশ নিতাম। এখন বাড়তে বাড়তে সেটা ২০ হাজার টাকায় পৌঁছেছে। চরমোনাইয়ের মাহফিলে দোকান বসাতে এখন ১৫-১৬ হাজার টাকা লাগে।’
বিকাশের মতো বিধান ঘোষও মেলায় মেলায় মিষ্টি বিক্রি করেন। সংসার আলাদা হলেও ব্যবসা একই আছে। বড় মেলাগুলোতে দুই ভাইয়ের যৌথ অংশগ্রহণ থাকে। মেলা শেষে লভ্যাংশ ভাগ করে নেন। তবে এখন বয়স বাড়ায় তাঁরা ব্যবসায় অংশীদার বাড়িয়েছেন। গ্রামের আরও দুজনকে সঙ্গে নিয়েছেন।
বিধান ঘোষ বলছিলেন, ‘চলতি মিষ্টি বেশি করি। কিছু বড় মিষ্টিও তৈরি করি। তবে বিশেষের চেয়ে ঝোঁক থাকে যেগুলোর বেশি কাটতি, সেগুলোয়। যেহেতু ভ্রাম্যমাণ দোকান, তাই গুঁড়া দুধেই মিষ্টি তৈরির কাজ চলে।’ বাড়ি থেকে গামলা, কড়াই, হাঁড়িপাতিলসহ অন্যান্য জিনিস নিয়ে আসেন তাঁরা। মেলার পাশের বড় বাজার থেকে দুধ-চিনি এসব পণ্য কেনেন। মেলার আশপাশ থেকে কিনতে হয় জ্বালানি কাঠ। এখন তাদের পুঁজি খাটে আগের চেয়ে বেশি। আর বাজারের সবকিছুর দাম বাড়ায় মিষ্টির দামও বাড়িয়েছেন।
মেলায় মিষ্টির দোকান বসানোর এই কাজ অনেক কষ্টের। বছরের বড় একটা সময় বাড়িঘর ফেলে এখানে-সেখানে থাকতে হয়। এমন কথা জানিয়ে বিধান ঘোষ বলছিলেন, ‘মেলায় মেলায় যাওয়ার এই কাজ অনেক খাটুনির, ঝক্কির। আর ঝড়–বৃষ্টি হলে কষ্ট বহুগুণ বেড়ে যায়। তবে ছোটবেলা ধরে এটাই করি, তাই এটা শুধু পেশা না, নেশাও। তিন-চার পুরুষের পেশা হওয়ায় যত দিন শরীরে কুলায়, তত দিন চালিয়ে যাব।’
তবে বংশপরম্পরার এই পেশা পরের প্রজন্ম ধরে রাখবে না বলে মনে করেন বিধান ঘোষ। তিনি বলেন, ভাইয়ের ছেলে পড়ালেখা করে। তাঁর সন্তানেরা অন্য ব্যবসা করে। তাদের ছেলেমেয়েরা এই কাজ বোঝে না। এই পেশায় আসতে পারবে না।