টাঙ্গাইলের মির্জাপুর

ফসলি জমির মাটি ভাটায় বিক্রি

তিনটি খননযন্ত্র দিয়ে কাটা মাটি প্রতিদিন প্রায় ২৪০টি ট্রাকযোগে অন্যত্র নেওয়া হচ্ছে। একটি ট্রাকে গড়ে ৭০০ ঘনফুট মাটি বহন করা হয়।

টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে আবাদি জমি ও লৌহজং নদের পাড় কেটে ইটভাটায় মাটি নেওয়া হচ্ছে। তিন মাস ধরে এভাবে মাটি কাটা হচ্ছে। গত শনিবার দুপুরে উপজেলার চান্দুলিয়া-কলিমাজানী এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলায় খননযন্ত্র দিয়ে লৌহজং নদের পাড় ও আবাদি জমির মাটি কেটে ইটভাটায় নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এ অবস্থায় চান্দুলিয়া ও কলিমাজানী গ্রামের আবাদি জমি ও বসতবাড়ি হুমকির মুখে পড়েছে।

এদিকে এ দুই গ্রামের পূর্ব দিকে নদে পাঁচটি খননযন্ত্র দিয়ে অবৈধভাবে বালু তোলা হচ্ছে। বালু তোলার কাজে ছাত্রলীগের সাবেক নেতাসহ চারজন জড়িত বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

চান্দুলিয়া গ্রামটি বহুরিয়া ইউনিয়ন ও কলিমাজানী গ্রাম গোড়াই ইউনিয়নের মধ্যে পড়েছে। দুই গ্রামের লোকজন বলেন, মির্জাপুরের দেওহাটা-বহুরিয়া সড়কের দুই পাশে প্রায় ৩০টি ইটভাটা রয়েছে। ইটভাটাগুলোতে স্থানীয় বিভিন্ন এলাকার মাটি কেটে ব্যবসায়ীরা বিক্রি করেন। প্রায় তিন মাস আগে থেকে চান্দুলিয়াতে খননযন্ত্র (এক্সকাভেটর) দিয়ে মাটি কাটা শুরু হয়।

ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি কৃষিজমি থেকে মাটি কেটে বা সংগ্রহ করে, তা ইটের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন না। অথচ অবাধে ওই এলাকা থেকে জমির উপরিভাগের ২৫ ফুট পর্যন্ত খুঁড়ে মাটি তোলা হচ্ছে।

স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, উপজেলার দেওহাটা গ্রামের ইলিয়াস হোসেন, ফরিদ হোসেন ও সারোয়ার হোসেন নামের তিন ব্যক্তি সেখান থেকে মাটি কেটে পাশের ইটভাটায় বিক্রি করছেন। আবাদি জমি থেকে মাটি কাটায় একদিকে আবাদি জমি হারিয়ে যাচ্ছে। জমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে। পাশাপাশি নদ ও নদের পাড় থেকে বালু তোলা হচ্ছে। এ অবস্থায় বর্ষাকালে নদে পানি বাড়লেই একরের পর একর জমি বিলীন হয়ে যাবে।

গত শনিবার সরেজমিনে দেখা যায়, চান্দুলিয়া ও কলিমাজানী গ্রামের আবাদি জমি থেকে খননযন্ত্র (এক্সকাভেটর) দিয়ে মাটি কাটা হচ্ছে। তিনটি খননযন্ত্র দিয়ে মাটি কেটে ট্রাকে তোলা হচ্ছে। স্থানীয় এক ব্যক্তির তথ্যমতে মুঠোফোনে কথা হয় মীর দেওহাটা গ্রামের ইটভাটার মালিক মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, তাঁর ইটভাটায় চান্দুলিয়া থেকে মাটি আসে না। ওই এলাকার মাটি কোর্টবহুরিয়াসহ আশপাশে থাকা ১৯টি ইটভাটায় নেওয়া হয়।

মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘ওই দিকের মাটি ওই দিকের খোলা (ইটভাটা) এলারা কাটে। আমাগো ওই মাটিতে পুষায় না। ওই দিকের ১৯টা খোলা। ব্যাক খোলায়ই মাটি চালায়। আমার খোলার খ্যাতের কোলা দিয়ে রেতি পড়ে তাই দিয়া খোলা চালায়।’

দেওহাটা গ্রামের ইলিয়াস হোসেন জানান, তিনি ছাড়াও স্থানীয় ফরিদ হোসেন ও সারোয়ার হোসেন মাটি কেটে ভাটায় বিক্রি করছেন।

ওই এলাকায় গরু চরাচ্ছিলেন মো. লুমান খান (৬৬)। তিনি বলেন, একদিকে গভীর করে মাটি কাটা হচ্ছে, যাতে অন্য জমির মালিকেরা মাটি বিক্রি করতে বাধ্য হন। তাঁর জমিতে ধান বুনেছেন। সেই জমির পাশে প্রায় ২৫ ফুট গভীর করে মাটি কাটা হয়েছে। এতে তাঁর খেতের কিছু অংশের মাটি ধসে যাওয়াতে ধানের ক্ষতি হয়েছে।

খননযন্ত্রের চালক মো. ফয়সাল আমিন এক মাস ধরে মাটি কাটার কাজ করছেন। তিনি জানান, গড়ে প্রতিদিন তিনি ৮০টি ট্রাকে মাটি তুলে দেন। মাটি ১৪-১৫ ফুট গভীর করে কাটা হচ্ছে।

চালকদের হিসাবমতে, তিনটি খননযন্ত্র দিয়ে কাটা মাটি প্রতিদিন প্রায় ২৪০টি ট্রাকযোগে অন্যত্র নেওয়া হচ্ছে। একটি ট্রাকে গড়ে ৭০০ ঘনফুট মাটি বহন করা হয়। প্রতি ট্রাক মাটি তিন হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। সে হিসাবে গড়ে প্রতিদিন ওই স্থান থেকে ১ লাখ ৬৮ হাজার ঘনফুট মাটি ইটভাটায় নেওয়া হয়েছে। যার মূল্য প্রায় ৭ লাখ ২০ হাজার টাকা। গত তিন মাসে ওই স্থান থেকে ৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকার মাটি বিক্রি হয়েছে।

এদিকে ওই স্থান থেকে নদের পূর্ব দিকে প্রায় এক কিলোমিটার এলাকায় পাঁচটি স্থানে ড্রেজার দিয়ে নদ থেকে বালু তোলা হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এতে গোড়াই ইউনিয়ন (পশ্চিম) ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান, এমারত হোসেন, ইমরান হোসেন, আলিম মিয়া জড়িত।

আলিম মিয়া বলেন, তিনি তিন-চার দিন ধরে বালু তোলা শুরু করেছেন। তবে প্রশাসনের কারও অনুমতি নেননি। আর মিজানুর রহমান জানান, গত শনিবারই তিনি খননযন্ত্র চালু করেছেন।

উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, কৃষিজমি থেকে মাটি কাটা বা নদ থেকে বালু তোলা নিষেধ রয়েছে। খোঁজ নিয়ে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।