নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড কমিটি গঠন নিয়ে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের মধ্যে বিভক্তি এখন প্রকাশ্যে। কমিটিতে দলের ত্যাগী ও জ্যেষ্ঠ নেতাদের বাদ দিয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের নিয়ে কমিটি গঠন করার অভিযোগ তুলে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেনকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছেন নারায়ণগঞ্জ সিটি মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী। তিনি পাল্টা কমিটি দেওয়ার হুমকিও দিয়েছেন। অন্যদিকে পদবঞ্চিত নেতারা মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন। এ নিয়ে নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
১২ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের ১৭টি ওয়ার্ডের কমিটি ঘোষণা করা হয়। মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহা মহানগর আওয়ামী লীগের ১১ থেকে ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের কমিটি ঘোষণা করেন। তবে সিদ্ধিরগঞ্জের ১ থেকে ১০ নম্বর ওয়ার্ড নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের সংসদীয় এলাকা হওয়ায় ওই ওয়ার্ডগুলোতে কোনো কমিটি গঠন করা হয়নি। নির্বাচনের আগেই ওয়ার্ডগুলোতে সম্মেলন করা হয়েছে। ওই সম্মেলনে যেখানে একক প্রার্থী ছিলেন, তাঁদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। যেখানে একাধিক প্রার্থী ছিলেন, তাঁদের সম্মতি নিয়ে দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সিদ্ধান্ত দিয়ে কমিটি ঘোষণা করেছেন বলে জানিয়েছেন মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি আনোয়ার হোসেন।
এ নিয়ে গত শুক্রবার শহরের দেওভোগ এলাকায় ১৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে পদবঞ্চিত নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি সেলিনা হায়াৎ আইভী। ওই বৈঠকে দলের ত্যাগী ও জ্যেষ্ঠদের বাদ দিয়ে কমিটি করায় মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেনকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন। তাঁকে না জানিয়ে কমিটি করায়, তিনি আগের কমিটি বহাল না হলে পাল্টা ওয়ার্ড কমিটি দেওয়ার হুমকি দেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে দুটি ধারায় বিভক্ত ছিল। আওয়ামী লীগের একটি অংশের নেতৃত্ব দিতেন নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন ও নারায়ণগঞ্জ সিটি মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী। অপর একটি অংশের নেতৃত্ব দেন ওসমান পরিবার ও তাদের ঘনিষ্ঠ অনুসারীরা। মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওসমান পরিবারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত। কিন্তু ঘোষিত ওয়ার্ড কমিটি নিয়ে সিটি মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর সঙ্গে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেনের প্রকাশ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। আনোয়ার হোসেনকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করায় দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।
পদবঞ্চিত মনোয়ার হোসেন দীর্ঘদিন ধরে ১৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ও রফিকুল ইসলাম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি সম্পর্কে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র আইভীর মামা। তাঁকে বাদ দিয়ে এবার জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি খালেদ এপনকে সভাপতি ও মাহবুবুল আলমকে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করা হয়েছে। ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক পদপ্রত্যাশী সাব্বির হোসেন মহানগর আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে তালা লাগিয়ে দেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের কয়েক নেতা বলেন, আনোয়ার হোসেন স্বার্থের জন্য শামীম ওসমানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এবারও তিনি স্বার্থের জন্য আইভীর মামা ১৬ নম্বর ওয়ার্ড সভাপতি মনোয়ার হোসেনকে বাদ দিয়ে কমিটি করেছেন। তিনি ব্যক্তিস্বার্থের জন্য পকেট কমিটি করেছেন।
পদবঞ্চিত ১৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকপ্রত্যাশী ছিলেন সাব্বির আহমেদ। তিনি মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটির সদস্য। সাব্বির আহমেদ অভিযোগ করেন, ওই ওয়ার্ডে সম্মেলনে সভাপতি পদে পাঁচজন ও সাধারণ সম্পাদক পদে তিনজন পদপ্রত্যাশী ছিলেন। তাঁদের কাউকে সমন্বয় করতে পারেননি, পরে নির্বাচন দেবেন বলে জানিয়েছিলেন নেতারা। কিন্তু তাঁরা নির্বাচন না দিয়ে নিজের পকেট ভারী করে কাউকে খুশি করতে এই পকেট কমিটি ঘোষণা করেছেন। এই ওয়ার্ডে মেয়র আইভীসহ আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা থাকলেও তাঁদের কারও সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি। এ কমিটি তাঁরা মানেন না। এ কারণে তাঁরা দলীয় কার্যালয়ে তালা দিয়েছেন। দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ ছাড়া তাঁরা দলীয় কার্যালয় খুলবেন না।
এ প্রসঙ্গে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, যাচাই-বাছাই করে কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। কমিটি গঠনে যদি কোনো অনিয়ম হয়ে থাকে, সেটা কেন্দ্র দেখবে। তিনি দাবি করেন, ‘বিএনপির শাসনামলে আমরা রাজপথে পুলিশের সঙ্গে যখন মারামারি করি, তখন মনোয়ার রাজনৈতিক কর্মসূচিতে আসেননি। তাঁর ছেলে যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ কারণে তাঁকে সভাপতি করা হয়নি। কমিটি থেকে মামা বাদ পড়ায় আইভী ক্ষুব্ধ হয়েছেন।’ তাঁকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা প্রসঙ্গে আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘সন্তান (আইভী) যদি বাবাকে গালি দেয়, বাবা কি সন্তানকে গালি দিতে পারে? দল ক্ষমতায়, কেউ যদি দলীয় কার্যালয়ে তালা দেন; সেটা দলীয় প্রধান ও প্রশাসন বুঝবে।’
শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহা। দলের ত্যাগী ও জ্যেষ্ঠ নেতাদের বাদ দিয়ে কমিটি করার অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মহানগর আওয়ামী লীগের সভায় শামীম ওসমানের উপস্থিতিতে সিদ্ধান্ত হয়েছে—কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক যে সিদ্ধান্ত দেবেন, তাঁরা তা মেনে নেবেন। সেখানে পদবঞ্চিত ব্যক্তিরাও উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা এখন কেন দলীয় কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়েছেন, এ বিষয়ে তিনি গণমাধ্যমে কথা বলতে চান না। এটি দলের অভ্যন্তরীণ বিষয়, দলীয় ফোরামে তিনি কথা বলবেন।