চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার খারিপাড়া গ্রামে ওঁরাও শিশুশিক্ষার্থী। এদের মাতৃভাষাযর বই ছাপানো হলেও বিদ্যালয়ে তারা মাতৃভাষায় শিক্ষা থেকে বঞ্চিত
চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার খারিপাড়া গ্রামে ওঁরাও শিশুশিক্ষার্থী। এদের মাতৃভাষাযর বই ছাপানো হলেও বিদ্যালয়ে তারা মাতৃভাষায় শিক্ষা থেকে বঞ্চিত

বই ছাপানো হলেও মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার পথে এখনো যত বাধা

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) আট বছর ধরে পর্যায়ক্রমে প্রাক্‌-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত সাদরি ভাষায় পাঠ্যবই প্রকাশ করে আসছে। সেগুলো জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয় হয়ে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ে আসছে। এরপর বিভিন্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাচ্ছে। কোথাওবা যাচ্ছে না। কিন্তু বিদ্যালয়গুলোতে সাদরিভাষী ওঁরাও, মুন্ডা, রাজোয়ার প্রভৃতি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শিশুরা মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা পাচ্ছে না।

উত্তরাঞ্চলের চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় সাদরিভাষী ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের বসবাস। এ জনগোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার জন্য সাদরি ভাষায় পাঠ্যবই ২০১৭ সাল থেকে প্রকাশ করে আসছে। কিন্তু বিদ্যালয়ে তা পড়ানো হচ্ছে না বলে প্রথম আলোর কাছে নিশ্চিত করেছেন প্রাথমিক পর্যায়ের পাঠ্যবই উন্নয়ন ও অভিযোজনে এনসিটিবিকে সহায়তাকারী সাদরিভাষী ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি সিরাজগঞ্জের যোগেন্দ্রনাথ সরকার, নওগাঁর বঙ্গপাল সরদার ও রাজশাহীর কল্যাণী মিনজ।

কল্যাণী মিনজ নিজেই রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি প্রথম আলোকে জানান, তাঁর বিদ্যালয়সহ আরও উপজেলার অন্যান্য বিদ্যালয়ে সাদরিভাষী ওঁরাও শিক্ষার্থী রয়েছে। কিন্তু চলতি বছর এ ভাষার কোনো বই দেওয়া হয়নি।

এ সম্প্রদায়ের অনেকেই খ্রিষ্টান হয়ে গেছে। তারা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নেই। বাংলা ভাষাতেই পড়তে চায় বলে শিক্ষকেরা সাদরি ভাষার বইয়ের চাহিদা পাঠাননি। ফলে জেলাতেও চাহিদা পাঠানো হয়নি।
মৃণাল কান্তি সরকার, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, নাচোল

নওগাঁ জেলাতেও একই অবস্থার কথা জানান বঙ্গপাল সরদার। তিনি বলেন, ‘আট বছর থেকে এনসিটিবি সাদরি, চাকমা, মারমা, গারো ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর ককবরক ভাষায় পর্যায়ক্রমে প্রাক্‌-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণির বই প্রকাশ করে আসছে। পাহাড়ে পরিস্থিতি কিছুটা ভালো থাকলেও সমতলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শিশুরা মাতৃভাষায় শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অথচ বই ছাপিয়ে সরকারি অর্থের অপচয় হচ্ছে। মাতৃভাষায় শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হচ্ছে না। বই ছাপানোর পাশাপাশি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, সাদরিভাষী শিক্ষক অথবা এ ভাষার খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে এ সমস্যার সমাধান হওয়া দরকার। তবে আশার কথা হচ্ছে, সাদরি ভাষায় পড়ানোর জন্য শিক্ষক সহায়িকা বা গাইড তৈরির কাজ হাতে নিয়েছে এনসিটিবি। এ জন্য আমাদের ডাকা হয়েছিল।’

কারও ধর্ম পরিবর্তন হলেও তাদের জাতীয়তা বা ভাষার পরিবর্তন হয় না। বিষয়টি একজন শিক্ষা কর্মকর্তার না জানা দুঃখজনক। এটা একধরনের অবহেলা।
বঙ্গপাল সরদার, প্রাথমিক পর্যায়ের পাঠ্যবই উন্নয়ন ও অভিযোজনে এনসিটিবিকে সহায়তাকারী

যোগেন্দ্রনাথ সরকার প্রথম আলোকে জানান, সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ ও তাড়াশ উপজেলার সাদরিভাষী শিক্ষার্থীদের হাতে মাতৃভাষার বই পৌঁছালেও বিদ্যালয়ে শিক্ষা পাচ্ছে না। তিনি বলেন, সরকারের এটি একটি মহতী উদ্যোগ। কিন্তু স্বভাষার শিক্ষক নিয়োগ না করার জন্য এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হচ্ছে না। তিনি সাদরিভাষী শিক্ষক নিয়োগের দাবি জানান।

জাতীয় আদিবাসী পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার বাসিন্দা বিচিত্রা তিরকি প্রথম আলোকে জানান, তাঁর ইউনিয়ন পার্বতীপুরে জিনারপুর, দেও পুরা ও বড়দাদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ওঁরাও শিশুরা পড়ে। বই দেওয়া হলেও বিদ্যালয়ে পড়ানো হয় না। সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত না হওয়ার বিষয়টি খুবই দুঃখজনক।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নাচোল উপজেলার নেজামপুর ইউনিয়নের ফুলকুঁড়ি নবযুগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাক্‌-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মুন্ডা ও ওঁরাও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ৩০ জন ও বরেন্দা লালজাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩০ জন শিক্ষার্থী পড়ে। কিন্তু এ বছর তাদের সাদরি ভাষার বই দেওয়া হয়নি।

এ দুটি বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা জানান, তাঁদের কাছে সাদরি ভাষার বইয়ের জন্য চাহিদাও চেয়ে পাঠানো হয়নি উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে।

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার বাবুডাইং গ্রামে কোল ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শিশুশিক্ষার্থী। এদের মাতৃভাষার বই নেই

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নাচোল উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মৃণাল কান্তি সরকার প্রথম আলোকে বলেন, এ সম্প্রদায়ের অনেকেই খ্রিষ্টান হয়ে গেছে। তারা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নেই। বাংলা ভাষাতেই পড়তে চায় বলে শিক্ষকেরা সাদরি ভাষার বইয়ের চাহিদা পাঠাননি। ফলে জেলাতেও চাহিদা পাঠানো হয়নি।

এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বঙ্গপাল সরদার বলেন, ‘কারও ধর্ম পরিবর্তন হলেও তাদের জাতীয়তা বা ভাষার পরিবর্তন হয় না। বিষয়টি একজন শিক্ষা কর্মকর্তার না জানা দুঃখজনক। এটা একধরনের অবহেলা। বিদ্যালয়ে পড়ানো না হলেও শিক্ষার্থীদের হাতে মাতৃভাষার পাঠ্যবই যাওয়া এক ধাপ অগ্রগতি বলে মনে করি আমরা। একদিন নিশ্চয়ই শিক্ষক নিয়োগ হবে বা বাঙালি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।’

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. জেছের আলী প্রথম আলোকে জানান, সদর উপজেলায় ৫১৮টি ও গোমস্তাপুর উপজেলায় ৫২০টি সাদরি ভাষার বই দেওয়া হয়েছে। নাচোল উপজেলা থেকে চাহিদা না আসায় পাঠানো হয়নি। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, শিক্ষকের অভাবে বিদ্যালয়ে পড়ানো না হলেও শিক্ষার্থীর বাড়িতে পড়ে। এতে মাতৃভাষায় দক্ষতা বাড়ে। সরকার শিক্ষক প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে। প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হলে আর সমস্যা থাকবে না।

এদিকে সমতলে অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তার চেয়ে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মানুষদের সংখ্যাই সর্বাধিক। কিন্তু সাঁওতাল শিশুদের জন্য মাতৃভাষায় বই প্রকাশিত হয়নি।

উত্তরবঙ্গ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক প্রভাত টুডু এ প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে বলেন, সাঁওতাল একপক্ষ রোমান হরফে ও আর এক পক্ষ অলচিকি হরফে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের দাবি জানিয়ে আসছে। এ দুই পক্ষের মধ্যে মীমাংসা না হওয়ার অজুহাতে সরকার সাঁওতালি ভাষার বই প্রকাশ করছে না। দুই পক্ষের এ দ্বন্দ্ব নিরসন করে বই প্রকাশের দাবি জানান তিনি।