ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে শুধু তদন্ত কমিটিই হয়, শাস্তি হয় না

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

নিজেদের মধ্যে মারামারি, নিরাপত্তাকর্মীকে মারধর, সাংবাদিকদের মারধর ও ছাত্রীকে লাঞ্ছিত করার অভিযোগে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ২০২২ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত চারটি তদন্ত করা হয়েছে। তবে ওই সব ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ বা প্রতিবেদনের সুপারিশের ভিত্তিতে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ব্যবস্থা না নেওয়ায় দিনে দিনে ছাত্রলীগ আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ করেছেন অনেক শিক্ষক ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

সবশেষ গতকাল মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি খন্দকার তায়েফুর রহমান ওরফে রিয়াদের উপস্থিতিতে ছাত্রলীগের কর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষককে লাঞ্ছিত করেছেন বলে অভিযোগ করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সংগঠন গণতান্ত্রিক শিক্ষক ফোরামের একাংশ।

আমরা অনেক আগেই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। তদন্ত প্রতিবেদনে কী সুপারিশ করা হয়েছে, সেটি বলার নিয়ম নেই। তবে সুপারিশ অনুযায়ী কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে মনে পড়ছে না।
অধ্যাপক সুকুমার সাহা, একটি তদন্ত কমিটির প্রধান

এ ঘটনার প্রতিবাদে গতকাল রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদের সম্মেলনকক্ষে সংবাদ সম্মেলন ও আজ বুধবার দুপুরে ক্যাম্পাসে মানববন্ধন করেন শিক্ষকেরা। গণতান্ত্রিক শিক্ষক ফোরামের (একাংশ) উদ্যোগে মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

ছাত্রলীগের লাঞ্ছনার শিকার ফিজিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী প্রক্টর আফরিনা মুস্তারি দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, তিনজন শিক্ষক লাঞ্ছনার শিকার হলেও আজ দুপুর পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০২২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের বিভিন্ন ধরনের সহিংস ঘটনায় চারটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। ওই চারটি ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হলেও তদন্তের পরিপ্রেক্ষিতে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন।

গত বছরের ১ জুন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি খন্দকার তায়েফুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসানের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটির প্রধান মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক সুকুমার সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা অনেক আগেই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। তদন্ত প্রতিবেদনে কী সুপারিশ করা হয়েছে, সেটি বলার কোনো নিয়ম নেই। তবে সুপারিশ অনুযায়ী কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে মনে পড়ছে না।’

গত বছরের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের কর্মসূচি পালন করা নিয়ে এক ছাত্রীকে লাঞ্ছিত করেন ছাত্রলীগের কর্মীরা। ওই ঘটনার জেরে ২৮ মার্চ ছাত্রলীগের কর্মীরা একটি গাড়ি ভাঙচুর ও এক সাংবাদিককে মারধর করেন। এ দুই ঘটনায় ২৯ মার্চ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। দুই মাস পর তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হলেও প্রতিবেদনে কী বলা হয়েছে, সেটি প্রকাশ করা হয়নি।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, গত ২৭ আগস্ট রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহজালাল হলে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনায় সহকারী প্রক্টরকে অপদস্থ করেন ছাত্রলীগের কর্মীরা। ঘটনার সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন সাংবাদিককেও মারধর করেন তাঁরা। এ ঘটনার তদন্ত কমিটির সদস্যসচিব আফরিনা মুস্তারি প্রথম আলোকে বলেন, তদন্তের প্রয়োজনে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ চাওয়া হলেও তা পাওয়া যায়নি। পরে অধিকতর তদন্তের জন্য সুপারিশ করে প্রতিবেদন দেওয়া হয়।

এর আগে গত বছরের ২৫ আগস্ট রাতে নূরুল আমিন নামের বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নিরাপত্তাকর্মীকে বেধড়ক পেটান ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী। এ ঘটনায় ২৯ আগস্ট ৪ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনও জমা দেওয়া হয়েছে। তবে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা এখনো নেওয়া হয়নি।
ছাত্রলীগের সভাপতি খন্দকার তায়েফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে গত বছর যতগুলো অভিযোগের তদন্ত হয়েছে, সব অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. ছাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছরের সব কটি ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন পেয়েছি। তদন্ত প্রতিবেদনগুলো আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা কমিটিতে পাঠিয়েছি। সব কটি প্রতিবেদনের সুপারিশের ভিত্তিতে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

শৃঙ্খলা কমিটির প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য লুৎফুল হাসান। এ বিষয়ে তাঁর মন্তব্য জানতে মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। বিষয়বস্তু জানিয়ে খুদে বার্তা পাঠালেও তিনি সাড়া দেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মুহাম্মদ মহির উদ্দিনকে ফোন করা হলে তিনি জরুরি সেমিনারে আছেন বলে ফোন কেটে দেন।