সুন্দরবনে মাছ ধরতে গিয়ে অপহরণের শিকার হচ্ছেন জেলেরা
সুন্দরবনে মাছ ধরতে গিয়ে অপহরণের শিকার হচ্ছেন জেলেরা

‘দস্যুমুক্ত সুন্দরবনে’ আবার বেড়েছে দস্যুদের উৎপাত, আতঙ্কে বনজীবীরা

নজরদারির অভাবে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনে দীর্ঘদিন পর আবার ডাকাতের উৎপাত বেড়েছে। ইতিমধ্যে বনজীবীদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের খবর পাওয়া যাচ্ছে। ধারালো অস্ত্র ও বন্দুক নিয়ে বনজীবীদের সব কেড়েও নিচ্ছেন দস্যুরা। নতুন নতুন ডাকাত দলকে বনের বিভিন্ন এলাকায় ঘোরাফেরা করতে দেখার কথা জানিয়েছেন স্থানীয় বনজীবীরা।

সম্প্রতি মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসা ও বনদস্যুদের হাত থেকে উদ্ধার হওয়া জেলেদের কাছ থেকে জানা যায়, খুলনার কয়রা, দাকোপ ও সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলাজুড়ে বিস্তৃতি পশ্চিম সুন্দরবনে আসাবুর বাহিনী, শরীফ বাহিনী, আবদুল্লাহ বাহিনী, মঞ্জুর বাহিনী, দয়াল বাহিনী নামে বনদস্যুদের নতুন কয়েকটি দল তৎপরতা শুরু করেছে। গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জেল ভেঙে পালিয়ে আসা কয়েদি ও চিহ্নিত আসামিরাও সুন্দরবনে দস্যুতা শুরু করেছেন। তাঁরা সুন্দরবনে মৎস্য আহরণে যাওয়া জেলেদের কাছ থেকে মাছ, টাকা, মুঠোফোনসহ সবকিছু কেড়ে নিচ্ছেন। এমনকি বনে ঢুকলে জেলেদের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের চাঁদাও দাবি করছেন। গত তিন মাসে পশ্চিম সুন্দরবনে অন্তত তিনটি অপহরণের ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এর বাইরেও অপহরণের ঘটনা ঘটলেও জেলেরা পরবর্তী ঝামেলা এড়াতে প্রকাশ করতে চান না।

বন বিভাগ ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ধাপে ধাপে সুন্দরবন অঞ্চলের ৩২টি দস্যু বাহিনীর ৩২৮ জন দস্যু ৪৬২টি অস্ত্র ও ২২ হাজার ৫০৪টি গোলাবারুদসহ আত্মসমর্পণ করেছিলেন। পরে ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর প্রাণবৈচিত্র্যে ভরা সুন্দরবনকে ‘দস্যুমুক্ত’ ঘোষণা করা হয়।

৮ নভেম্বর সুন্দরবনের মালঞ্চ নদের সাতনলা দুনে এলাকায় মাছ ধরার সময় অস্ত্রধারী বনদস্যু বাহিনীর হাতে জিম্মি হন কয়রা উপজেলার কালিকাপুর গ্রামের আতাহার হোসেন (৩৫) ও রফিকুল ইসলাম (৩৮)। ওই জেলেদের বহরে চারটি নৌকায় আটজন জেলে ছিলেন। মুক্তিপণের দাবিতে দুই জেলেকে আটকে রেখে অন্যদের ছেড়ে দেন দস্যুরা।

এই বাহিনীর অনেকেই আগে মজনু বাহিনীর সদস্য ছিলেন বলে দাবি ফিরে আসা জেলেদের। জেলে রবিউল ইসলাম ও আছাদুল গাজী বলেন, তাঁরা কয়েক দিন আগে সুন্দরবনে প্রবেশ করে বনের ফিরিঙ্গি এলাকায় মাছ শিকারের পর গত বৃহস্পতিবার মালঞ্চ নদে পৌঁছান। শুক্রবার সকালে সেখানকার সাতনলার দুনে এলাকায় মাছ শিকারের সময় দয়াল বাহিনী পরিচয়ে বনদস্যুদের একটি দল তাঁদের জিম্মি করে। এ সময় দুই জেলেকে উঠিয়ে নিয়ে চার লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে তারা।

ওই দুই জেলে ১১ নভেম্বর সকালে কালিকাপুর গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসার তথ্য নিশ্চিত করে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য ফেরদৌস ঢালী প্রথম আলোকে বলেন, দস্যুদের মুক্তিপণের টাকা দিয়ে জেলে আতাহার ও রফিকুল বাড়িতে ফিরে এসেছেন। কয়েক বছর পর সুন্দরবনে আবার ডাকাত নেমেছে। এলাকার বনজীবী ও জেলেরা এ নিয়ে খুবই চিন্তিত। দস্যুতা দমনে প্রশাসনকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ করেন তিনি।

আনোয়ার আলী নামের এক জেলে বলেন, আবদুল্লাহ বাহিনী নামে ১০–১২ জনের একটি ডাকাত দল সুন্দরবনের দারগাং, আঠারোবেকী, কাচিকাটা, রায়মঙ্গল, কচুখালী, মাওন্দো নদীতে অবস্থান করছে। তারা জেলেদের ধরে নৌকায় যা পাচ্ছে, সেগুলো তুলে নিচ্ছে। আবার বনে প্রবেশ করলে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে প্রবেশ করতে বলছে।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার কালিঞ্চি গ্রামের আবদুল্লাহ তরফদার (৪২) নারী পাচার মামলায় কারাগারে ছিল। ৫ আগস্ট রাতে সাতক্ষীরা জেলা কারাগার ভাঙচুর করা হলে সেখান থেকে পালিয়ে যান আবদুল্লাহ। পরে সুন্দরবনে প্রবেশ করে বনদস্যুতায় নামেন। আবদুল্লাহর সঙ্গে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশ কারাগার থেকে পালিয়েছেন বলে জানা গেছে।

সম্প্রতি বনদস্যুদের হাত থেকে উদ্ধার হওয়া সুন্দরবনসংলগ্ন ভেটখালী গ্রামের জেলে নজরুল ইসলাম জানান, ৩১ অক্টোবর সকালে সুন্দরবনের ধানুখালী এলাকা থেকে মঞ্জুর বাহিনী পরিচয়ে ডাকাতেরা তাঁকে অপহরণের পর মুক্তিপণ দাবি করে। টাকা দিতে আপত্তি করায় আটকে রেখে বেদম মারপিট করা হয়। ৩ নভেম্বর সকালে বন বিভাগ অভিযান চালিয়ে তাঁকে উদ্ধার করে।

ওই অভিযানের বিষয়ে বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক এ জেড এম হাসানুর রহমান বলেন, সুন্দরবনের তক্কাখালী এলাকায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালাতে গেলে দস্যুরা বন বিভাগের সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। জবাবে বনকর্মীরাও পাল্টা গুলি ছোড়েন। এ সময় প্রতিরোধের মুখে বনদস্যুরা পালিয়ে যান। ঘটনাস্থল থেকে অপহৃত ১০ জেলে, ৩টি নৌকা, ১টি সোলার প্যানেল ও ১টি গুলি উদ্ধার করা হয়।

আমাকে সুন্দরবনের শরবত খালীর খাল এলাকা থেকে অপহরণের পর বেদম মারপিট করে রক্তাক্ত জখম করে আসাবুর বাহিনী। এরপর আমার পরিবারের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে ১০ হাজার ২০০ টাকা দিয়ে মুক্তি পেয়েছি।
অহিদুল শেখ, সুন্দরবনসংলগ্ন কালাবগি গ্রামের বাসিন্দা

সবশেষ গত মঙ্গলবার সুন্দরবনের ঠাকুরবাড়ি ঘাট এলাকা থেকে আসাবুর বাহিনীর প্রধান আসাবুর সানাসহ (৪২) দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের সদস্যরা। এ সময় তাঁদের কাছ থেকে ২টি একনলা বন্দুক ও ৪টি গুলি উদ্ধার করা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে দাকোপ থানায় একটি অবৈধ অস্ত্র মামলা ও ২টি ডাকাতিসহ একাধিক মামলা রয়েছে বলে জানিয়েছেন কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের অপারেশন কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার শামসুল আরেফীন।

বনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিন মাস ধরে সুন্দরবনের পশ্চিমাংশে দস্যু আসাবুর বাহিনী তৎপর। ৪৪ বছর বয়সী এই দস্যুর পুরো নাম আসাবুর সানা। তিনি দাকোপ উপজেলার সুতারখালী ইউনিয়নের কালাবগি গ্রামের বাসিন্দা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, ২০০৩ সালে সুন্দরবনে মৃত্যুঞ্জয় বাহিনীর প্রধান আকাশ বাবুর সঙ্গে আসাবুর ডাকাতি শুরু করেন। পরে তিনি বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে মিলে দস্যুতা করতেন। একপর্যায়ে অস্ত্রসহ কোস্টগার্ডের কাছে আটক হন। ওই অস্ত্র মামলায় তিন বছর কারাভোগ করে ২০১৫ সালে জামিনে মুক্তি পান।

ওই এলাকার ইউপি সদস্য রফিকুল ইসলাম বলেন, স্থানীয় ব্যক্তিদের কাছ থেকে শুনেছেন, ৭ আগস্ট থেকে আসাবুরের বাহিনী বনে দস্যুতা করতে নেমেছে। তাঁর এলাকার অন্তত ৪০ জন জেলে কয়েক দফায় সম্প্রতি অপহৃত হয়েছিলেন। পরে তাদের দেওয়া একটি বিকাশ নম্বরে খরচসহ ২০ হাজার ৪০০ টাকা করে পাঠাতে হয়েছে। তারপর জেলেদের মুক্তি মিলেছে।

সুন্দরবনসংলগ্ন কালাবগি গ্রামের অহিদুল শেখ বলেন, ‘আমাকে সুন্দরবনের শরবত খালীর খাল এলাকা থেকে অপহরণের পর বেদম মারপিট করে রক্তাক্ত জখম করে আসাবুর বাহিনী। এরপর আমার পরিবারের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে ১০ হাজার ২০০ টাকা দিয়ে মুক্তি পেয়েছি।’

সুন্দরবন খুলনা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক এম এ হাসান বলেন, দস্যুমুক্ত সুন্দরবনে আবারও কিছু দুষ্কৃতকারী নতুন করে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে চাইছে। তবে তারা বড় কোনো ডাকাত দল না। তাদের অতটা অস্ত্রও নেই। মূলত জেলেদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। প্রতিটি টহল ফাঁড়িকে এ বিষয়ে অবহিত করা হয়েছে। দ্রুত আরও জোরালো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

নজরদারি ও তদারকির অভাবে সুন্দরবনে আবারও দস্যুদের উৎপাত বেড়েছে বলে মনে করেন সুন্দরবন সুরক্ষা আন্দোলনের সভাপতি শেখ হারুন অর রশীদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের অপরাধ চলতে থাকলে একদিকে যেমন বনজীবীদের জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে, অন্যদিকে সুন্দরবন থেকে রাজস্ব আদায়ও কম হবে। সুন্দরবনে পর্যটকের সংখ্যাও কমে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। বিপন্ন হবে বেঙ্গল টাইগার, বন্য প্রাণী আর প্রাণবৈচিত্র্য। এখনই দস্যুদের দমন না করলে কিছুদিনের মধ্যে অস্ত্র বাড়াবেন তাঁরা। দল বড় হবে। এ জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবশ্যই সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখতে হবে।