নিহত মো. রাজুর ছবি হাতে কাঁদছেন ছোট বোন খাদিজা খাতুন। পাশে বাবা নিজাম উদ্দিন
নিহত মো. রাজুর ছবি হাতে কাঁদছেন ছোট বোন খাদিজা খাতুন। পাশে বাবা নিজাম উদ্দিন

হাসপাতালে স্ত্রীর সামনে থেকে লাশ নিয়ে যায় পুলিশ, সেই লাশ এখন ‘গায়েব’

গাজীপুরের টঙ্গীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিতে নিহত হয়েছিলেন মো. রাজু। হাসপাতালে গিয়ে তাঁর লাশ দেখতে পান স্ত্রী রেহেনা পারভীন। তবে তাঁর সামনে থেকেই লাশ নিয়ে যায় পুলিশ। পরে থানা ও হাসপাতালের মর্গে আর স্বামীর লাশ পাননি রেহেনা। ঘটনার দুই মাসের বেশি সময় পার হলেও সেই লাশের সন্ধান আর কেউ দিতে পারেননি।

নিহত মো. রাজু (২৭) ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার পূর্ব গোবরাকুড়া গ্রামের বাসিন্দা নিজাম উদ্দিনের ছেলে। তিনি স্ত্রী রেহেনা পারভীনকে নিয়ে টঙ্গীর সাতাইশ শরিফ মার্কেট এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। ২০২৩ সালের জুনে তাঁদের বিয়ে হয়। রেহেনা পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। রাজু গাজীপুরের বোর্ডবাজার ও উত্তরা এলাকায় বিভিন্ন খাবারের দোকানে শ্রমিকের কাজ করতেন। গত ২০ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান বলে স্বজনেরা দাবি করছেন।

নিহত মো. রাজু

স্বজনেরা জানিয়েছেন, তিন ভাই–বোনের মধ্যে রাজু বড়। গ্রামের লোকজন তাঁকে নাজির উদ্দিন নামে এবং টঙ্গীতে লোকজন মনির হোসেন নামে চিনতেন। তবে জাতীয় পরিচয়পত্রে তাঁর নাম ছিল মো. রাজু। আগে ত্রিশালে একটি মাছের খামারে কাজ করতেন রাজু। সেখানে জাতীয় পরিচয়পত্র হয় তাঁর। ২০ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান রাজু। টঙ্গীর ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে সরবরাহ করা একটি কাগজ তাঁদের (রাজুর স্বজন) হাতে রয়েছে। সেখানে মৃত অবস্থায় যাঁদের হাসপাতালে আনা হয়েছিল, তাঁদের তথ্য রয়েছে। ওই তালিকার ২ নম্বরে রয়েছে মনির হোসেনের নাম। তাঁর লাশ টঙ্গী পূর্ব থানার একজন এসআই নিয়ে গেছেন, বলে কাগজে উল্লেখ রয়েছে।

জীবিকার তাগিদে আবার পোশাক কারখানায় কাজ শুরু করেছেন রেহেনা পারভীন। তিনি মুঠোফোনে জানান, ২০ জুলাই বেলা ১১টার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে যান রাজু। কিছুক্ষণ পরই বাইরে মিছিলের শব্দ শুনতে পান। পাশে মাদ্রাসা থেকে একটি মিছিল বের হয়েছিল। টঙ্গীর সাতাইশ শরিফ মার্কেট এলাকার মাথায় যেতেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুলি করে। পরে জানতে পারি, দুপুর ১২টা থেকে সাড়ে ১২টার মধ্যে গুলি ছোড়া হয়েছিল।

নিহত মো. রাজু (২৭) ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার পূর্ব গোবরাকুড়া গ্রামের বাসিন্দা নিজাম উদ্দিনের ছেলে। তিনি স্ত্রী রেহেনা পারভীনকে নিয়ে টঙ্গীর সাতাইশ শরিফ মার্কেট এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গত ২০ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান রাজু।

স্বামী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন—রেহেনা পারভীন এ খবর পান ওই দিন বেলা তিনটার পর। তাঁর স্বামীর মুঠোফোন থেকে একজন তাঁকে ফোন করে জানান গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর। রেহেনা পারভীন বলেন, ‘খবর পাওয়ার আধা ঘণ্টার মধ্যে আমি হাসপাতালে (টঙ্গীর ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল) পৌঁছাই। সে সময় হাসপাতালে দুটি লাশ ছিল। দ্বিতীয় লাশটি ছিল আমার স্বামীর। আমি দেখেই চিৎকার করি। মাথার ডান দিকে ও বাঁ হাতে গুলি লেগেছিল। ওই সময় লাশ দেওয়ার জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কাগজপত্র তৈরি করছিল। এ সময় পুলিশ এসে সবাইকে সরিয়ে দেয়। তবু আমি একা লাশের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। পুলিশ আমাকে সরিয়ে দিয়ে লাশ নিয়ে যায়। লাশের খবর আজ পর্যন্ত পাইনি।’

রেহেনা পারভীন আরও বলেন, ‘কত হাসপাতালে গেছি, কত মর্গে গেছি। টঙ্গী পশ্চিম ও পূর্ব থানায় কতবার ঘুরপাক করেছি। কিন্তু স্বামীর লাশ পাইনি। সব তন্ন তন্ন করেছি। যেখানে আমার স্বামী গুলিবিদ্ধ হয়েছে, সেখানে গিয়ে কান্নাকাটি করার পর একজন লোক গুলিবিদ্ধ হওয়ার ভিডিও দিয়েছে আমাকে। সেগুলো সংরক্ষণ করে রেখেছি। আমরা এখনো মামলা করতে পারিনি।’

আমি তখন ওই এলাকার ডিসি ছিলাম না। বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে তিনি (নিহত রাজুর স্ত্রী) নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না, কোন থানার পুলিশ লাশ নিয়ে গেছে বা পুলিশ সদস্যের নাম কী।
আলমগীর হোসেন, গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (টঙ্গী জোন) আলমগীর হোসেন

এ বিষয়ে গতকাল সোমবার মুঠোফোনে গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (টঙ্গী জোন) আলমগীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ওই ঘটনায় একটি হত্যা মামলা হয়েছে। তদন্তে প্রকৃত ঘটনা জানা যাবে। দুই মাসেও লাশ খুঁজে না পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি তখন ওই এলাকার ডিসি ছিলাম না। বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে তিনি (রেহানা পারভীন) নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না, কোন থানার পুলিশ লাশ নিয়ে গেছে বা পুলিশ সদস্যের নাম কী।’

হাসপাতালের নথিতে টঙ্গী পূর্ব থানার নাম লেখা থাকার বিষয়ে আলমগীর হোসেন বলেন, ‘টঙ্গী পূর্ব থানায় ১৭–১৮ জন এসআই আছেন। এখন কোন এসআই লাশ নিয়েছেন বা তিনি আদৌ টঙ্গী পূর্ব থানার কি না, সেটাও দেখার বিষয়। এ জন্যই বলছি, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা প্রকৃত ঘটনা বের করবেন।’

নিহত রাজুর ছোট বোনের স্বামী লিয়াকত আলী বলেন, ‘খবর পেয়ে আমরা হাসপাতালে পৌঁছাতে রাত ১০টা বেজে যায়। আমরা গিয়ে লাশও পাইনি। রাস্তায় গণ্ডগোল থাকার কারণে আমাদের পৌঁছাতে দেরি হয়। পরে সারা রাত লাশ খুঁজেছি। পশ্চিম থানা বলে পূর্ব থানা লাশ নিয়ে গেছে, পূর্ব থানা বলে পশ্চিম থানা লাশ নিয়ে গেছে। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, লাশ পূর্ব থানা নিয়ে গেছে। এভাবেই ঘুরপাক খেয়েছি। বিভিন্ন স্থানে খোঁজ করে লাশ পাইনি। লাশটা পেলেও মা-বাবার মনকে সান্ত্বনা দেওয়া যেত। ছবি দেখলেই মা–বাবা কাঁদে।’

ছেলের লাশটা তো পাইলাম না। যদি পাইতাম, তাইলে আন্না মাডিচালি দিতাম। কব্বরডা দেইখ্যাও মনডা শান্ত অইতাম।
রাহেলা খাতুন, নিহত মো. রাজুর মা

রাজুই ছিল বৃদ্ধ মা-বাবার একমাত্র ছেলে। তাঁরা ছেলের মৃত্যুর খবর পেয়েছেন; গুলিবিদ্ধ লাশের ছবি ও ভিডিও দেখেছেন। কিন্তু তাঁর লাশ দেখতে পাননি। রাজুর বাবা নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘আগে ঠেলাগাড়ি চালাইতাম। পোলাই আমারে গাড়ি চালানি বন্দ কইর‍্যা ঘরে বয়া (বসিয়ে) খাওয়াইতো। কিন্তু হেই পোলারেই গুলি কইর‌্যা মারইর‌্যালছে, পোলার লাশটা পর্যন্ত পাইলাম না।’

মা রাহেলা খাতুন আহাজারি করতে করতে বলেন, ‘ছেলের লাশটা তো পাইলাম না। যদি পাইতাম, তাইলে আন্না মাডিচালি দিতাম। কব্বরডা দেইখ্যাও মনডা শান্ত অইতাম। অহন তো কিচ্ছুই নাই।’