ফাল্গুন–চৈত্র মাসে শাল–গজারির বনে প্রায়ই আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। গত রোববার টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার এমএম চালা বিটের আওতাধীন বিজ্ঞানাগার এলাকায় সেগুনবাগানে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়
ফাল্গুন–চৈত্র মাসে শাল–গজারির বনে প্রায়ই আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। গত রোববার টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার এমএম চালা বিটের আওতাধীন বিজ্ঞানাগার এলাকায় সেগুনবাগানে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়

বসন্ত এলেই পোড়ে সখীপুরের শাল-গজারির বন

গত এক মাসে উপজেলার বনাঞ্চলে অন্তত আটটি জায়গায় আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এসব ঘটনায় হুমকিতে পড়ছে বনের পরিবেশ।

বসন্ত ঋতু (ফাল্গুন-চৈত্র মাস) এলেই দুর্বৃত্তের আগুনে পোড়ে সখীপুরের শাল-গজারির বন। প্রতিবছর এ মৌসুমে বনে আগুন দেওয়ার কারণে পুড়ে যায় ছোট গজারিগাছ, ঝোপঝাড়, লতাপাতা, পোকামাকড়, কেঁচু ও কীটপতঙ্গ। এর ফলে জন্ম নেয় না নতুন গাছ। বিনষ্ট হয় বন্য প্রাণীর আবাসস্থল। বন পোড়ানোর কারণে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ। বিলুপ্ত হচ্ছে বন্য প্রাণী, কীটপতঙ্গ ও পাখি। ফলে প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।

গত এক মাসে সখীপুরের বনাঞ্চলে অন্তত আটটি জায়গায় আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। সর্বশেষ গত শনিবার রাতে উপজেলার ডিবি গজারিয়া বিটের আওতায় দেওবাড়ী গ্রামের একটি গজারিবন, এমএম চালা বিটের আওতায় বিজ্ঞানাগার এলাকার একটি সেগুনবাগান আগুনে পুড়ে যায়।

বনে আগুন দেওয়া অপরাধ। এতে জীববৈচিত্র্য ও বন্য প্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল ধ্বংস হয়। ফলে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি ও ভারসাম্য নষ্ট হয়।
গৌতম চন্দ্র চন্দ, বিভাগীয় সমন্বয়কারী, বেলা

এ ছাড়া শুধু এক বিট কার্যালয়ের আওতাধীন অন্তত ছয়টি স্থানে শাল-গজারির বনে আগুনের ঘটনা ঘটেছে। আগুনে পোড়া ওই জায়গাগুলো নলুয়া বিটের আওতাধীন দেওদীঘি বাজারের পশ্চিম পাশে দুটি গজারির বন, নলুয়া বিট কার্যালয়ের দক্ষিণ দিকে ৩০০ গজ দূরে একটি, ঘেচুয়া এলাকায় দুটি ও আমের চারা এলাকায় একটি বন।

সখীপুর ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের স্টেশন কর্মকর্তা বোরহান উদ্দিন জানান, কয়েক দিন আগে উপজেলার বহেড়াতৈল রেঞ্জের আমতৈল এলাকায় মধ্যরাতে একটি গজারি বনে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। ৯৯৯ থেকে ফোন পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা দ্রুত সেখানে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন।

৫ এপ্রিল নলুয়া বিটে সখীপুর-ঢাকা সড়কের ঘেচুয়া এলাকায় সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, সেখানে একটি বনে কে বা কারা ঘণ্টাখানেক আগে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। স্থানীয় মানুষদের ভাষ্য অনুযায়ী, গত এক সপ্তাহে অন্তত ছয়টি শাল-গজারির বন আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এতে অন্তত ১৫ একর জমির বন পুড়েছে।

আগুন দেওয়ার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। আইনগত ব্যবস্থা না নেওয়ায় বছরের পর বছর চলছে বন পোড়ানোর এমন ঘটনা। বনে আগুন প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি পরিবেশ আন্দোলনকারীদের।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) বিভাগীয় সমন্বয়কারী গৌতম চন্দ্র চন্দ মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, বনে আগুন দেওয়া অপরাধ। এতে জীববৈচিত্র্য ও বন্য প্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল ধ্বংস হয়। ফলে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি ও ভারসাম্য নষ্ট হয়। আগুন থেকে বনকে রক্ষা করতে এ মৌসুমে বন বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আরও সজাগ হতে হবে। অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

স্থানীয় বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সখীপুরে ৪টি রেঞ্জের আওতায় ১৩টি বিট কার্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১৫ হাজার একর জমিতে শাল-গজারির বন রয়েছে। বসন্তে, তথা ফাল্গুন-চৈত্র মাসে প্রকৃতির নিয়মে শাল-গজারির পাতা ঝরে পড়ে। বনাঞ্চলের আশপাশের বাসিন্দারা জমি দখল ও লাকড়ি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে রাতের বেলায় আবার কখনো দিনের বেলাতেও বনে আগুন দেন। ঝরাপাতাগুলো শুকনা থাকার কারণে মুহূর্তেই বনে আগুন ছড়িয়ে পড়ে।

এ প্রসঙ্গে নলুয়া বিট কর্মকর্তা সাফেরুজ্জামানের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয়। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘দুই সপ্তাহের মধ্যে কয়েকটি গজারির বনে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। আমরা খুবই সতর্ক অবস্থায় আছি। এতে গতবারের চেয়ে বনে আগুন লাগার ঘটনা কম ঘটেছে। আমার কার্যালয়ে তিনজন স্টাফ রয়েছেন। চার-পাঁচ হাজার একর জমির বন দেখভাল করতে গিয়ে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।’

বনাঞ্চলের মানুষদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বনের কাছাকাছি নিম্ন আয়ের মানুষের বসবাস বেশি। তাঁরা লাকড়ি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে অনেক সময় গজারি বনে আগুন দিয়ে থাকেন। কেউ বনের জমি দখলের উদ্দেশ্যে বন পোড়ানোর সঙ্গে জড়িত থাকেন। বনের ভেতরের সড়ক দিয়ে চলাচলকারীরাও অনেক সময় বনে আগুন দেন। মূলত জমিদখল আর লাকড়ি সংগ্রহ করতেই আগুন দিয়ে থাকে দুর্বৃত্তরা। এতে আগুনে বনের ছোট ছোট গজারিগাছ বেশি ক্ষতির শিকার হয়। পোড়া ছোট গাছগুলো কদিনেই শুকিয়ে যায়।

উপজেলার কালমেঘা গ্রামের বাসিন্দা কলেজশিক্ষক আবু কায়সার বলেন, প্রতিবছর এ মৌসুমে বনে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। কয়েক দিন আগেও দেওয়ানপুর গজারি বনে কয়েক একর গজারি বন পুড়ে গেছে। বহেড়াতৈল রেঞ্জের এমএম চালা বিটের আওতাধীন আন্ধী গ্রামের বাসিন্দা আবুল কাশেম জানান, বনের ভেতর অসংখ্য রাস্তা রয়েছে। পথচারীরা অনেক সময় বনে ঝরাপাতার স্তূপ দেখে আগুন ধরিয়ে দেন।