দুই বছরের কাজ ছয় বছরেও শেষ হয়নি। গাফিলতির অভিযোগে ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি বাতিল। নতুন দরপত্র আহ্বানের প্রস্তুতি।
রাজধানীর সঙ্গে মুন্সিগঞ্জের চার উপজেলার যোগাযোগ সহজ করতে ধলেশ্বরীর শাখা নদীর ওপর ২০১৮ সালে একটি সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল। প্রায় ছয় বছর হয়ে গেলেও ২৫২ মিটার দীর্ঘ সেতুটির কাজ শেষ হয়নি। অথচ চার বছর আগেই সেতুর কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। ফলে সেতু দিয়ে ধলেশ্বরী নদী পেরিয়ে ঢাকায় যাতায়াতের অপেক্ষা শেষ হচ্ছে না মুন্সিগঞ্জ সদর, টঙ্গিবাড়ী ও লৌহজংয়ের কয়েকটি ইউনিয়ন এবং সিরাজদিখান উপজেলার পাঁচ-ছয় লাখ মানুষের।
সিরাজদিখান উপজেলা ও দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ধলেশ্বরীর শাখা নদীর ওপর মোল্লারহাট এলাকায় এ সেতু নির্মাণের কাজ পাঁচ মাস ধরে বন্ধ রয়েছে। সময়মতো কাজ শেষ করতে না পারায় ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। সংস্থাটি বলছে, সেতুর কাজ ৭০ শতাংশ শেষ হয়েছে। এখন নতুন করে আবার দরপত্র আহ্বান করে বাকি কাজ শেষ করা হবে।
কেরানীগঞ্জ এলজিইডি সূত্রে জানা যায়, ৩৩ কোটি ২৭ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০১৮ সালের ৬ জুলাই সেতুটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। ১৩ খুঁটির ওপরে ১২টি স্প্যান বসিয়ে নির্মাণ করার কথা ছিল। সুরমা এন্টারপ্রাইজ নামের এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এই কাজের দায়িত্ব পায়। ২০২০ সালের ৫ ডিসেম্বর সেতুর কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। সময়মতো কাজ শেষ না হওয়ায় মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২২ সাল পর্যন্ত করা হয়। এরপর কাজটি শেষ হয়নি।
গত বৃহস্পতিবার বিকেলে মোল্লারহাটে নির্মাণাধীন সেতুটির দক্ষিণ প্রান্তে গিয়ে দেখা যায়, সেতুর তিনটি পিলার নির্মাণ করা হয়েছে। পিলারের ওপর দুটি স্প্যান বসানো হয়েছে। ধলেশ্বরী নদীর উত্তরপাড়েও তিনটি পিলারে দুটি স্প্যান বসানো হয়েছে। তবে নদীর মাঝখানে নির্মাণ করা পিলার দুটি এমনি পড়ে আছে। নদীর দক্ষিণ প্রান্তে নির্মাণসামগ্রী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে।
নির্মাণাধীন সেতুর ঠিক পূর্ব পাশ দিয়ে ছোট একটি দেশীয় ফেরিতে গাদাগাদি করে মুন্সিগঞ্জ সদর, সিরাজদিখান ও টঙ্গিবাড়ী উপজেলার মানুষেরা ঢাকায় যাতায়াত করছে।
ঘাটে কথা হয় এ পথে নিয়মিত যাতায়াতকারী অন্তত ১০ জনের সঙ্গে। তাঁরা জানান, মোল্লারহাট সেতুটি হলে মুন্সিগঞ্জ সদর থেকে টঙ্গিবাড়ীর বেতকা চৌরাস্তা, সিরাজদিখান ও মোল্লারহাট হয়ে ঢাকার পোস্তগোলা পর্যন্ত দূরত্ব দাঁড়াবে প্রায় ৩০ কিলোমিটার। তখন সদর এলাকা থেকে এ সড়ক পাড়ি দিয়ে ঢাকায় যেতে সময় লাগবে সর্বোচ্চ এক থেকে সোয়া এক ঘণ্টা। যেখানে মুক্তারপুর সেতু দিয়ে যেতে সময় লাগছে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা।
টঙ্গিবাড়ীর সোনার এলাকার বাসিন্দা নুর হোসেনের সঙ্গে কথা হয় খেয়াঘাট এলাকায়। তিনি বলেন, ‘৯-১০ বছর আগে সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা শুরু হয়। ছয় বছর ধরে চলছে নির্মাণকাজ। এর মধ্যে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করে শেষ হয়ে গেল। অথচ ছোট্ট এই সেতুর কাজ আর শেষ হলো না।’
কেরানীগঞ্জ এলজিইডির উপসহকারী প্রকৌশলী মো. শওকত আলী বলেন, সেতুর কাজ ৭০ শতাংশ শেষ হয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তাদের গাফলতির কারণে সময়মতো কাজ শেষ করতে পারেনি। এ জন্য তিন মাস আগে চুক্তি বাতিল করা হয়েছে।
উপজেলা প্রকৌশলী কাজী মাহমুদুউল্লাহ গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, অবশিষ্ট কাজের হিসাব করে ১২ কোটি টাকার বরাদ্দ চেয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি পাঠানো হয়েছিল। সে বরাদ্দের চিঠি পেয়েছেন। নতুন করে দরপত্র আহ্বান করে ঠিকাদার নিয়োগ দিয়ে আবার কাজ শুরু করা হবে।
কাজটি না করায় এক কোটি টাকা জরিমানা গুনতে হবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সুরমা এন্টারপ্রাইজকে। এ বিষয়ে পরিচালক মাসুম আলী বলেন, নির্মাণসামগ্রীর চড়া দাম। কাজটি করতে গেলে চার কোটি টাকা লোকসান হতো। সময়মতো কাজ শেষ না করার বিষয়ে তিনি বলেন, এলজিইডির সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বড় বড় ঠিকাদারি কোম্পানির কাছ থেকে সুবিধা নেন। যাদের কাছে সুবিধা পান, তাদের কাজের টাকা আগে দেন। তাঁদের টাকা আটকে রাখতেন। এ জন্য কাজ চালিয়ে যেতে পারেননি।
নদীর দুই পারে দেশের শীর্ষস্থানীয় একাধিক হাউজিং প্রতিষ্ঠানের প্রকল্প রয়েছে। নতুন করে দক্ষিণ পাশে আরও কোম্পানি আসছে। তারা কম দামে জমি কিনতে সেতু নির্মাণকাজ বিলম্বের ষড়যন্ত্র করছে বলে অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় লোকজনের। এ ছাড়া প্রতিদিন অর্ধলক্ষ মানুষ ও পণ্যসামগ্রী নৌযান দিয়ে নদী পারাপার হয়। দুই ঘাটে যাত্রী বহনের জন্য রয়েছে চার শতাধিক সিএনজিচালিত অটোরিকশা। প্রতিটি অটোরিকশা থেকে ঘাট কর্তৃপক্ষ পায় ৫০ টাকা। সেতু হলে জমি, ঘাট ও অটোরিকশা ব্যবসায় ভাটা পড়বে। স্থানীয় প্রভাবশালী ও জমি ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে সেতুর কাজ কখনো বন্ধ, কখনো ধীরগতি করতে করতে এ পর্যন্ত এসেছে বলে মনে করেন স্থানীয় লোকজন।
তবে কাজের ধীরগতির সঙ্গে এসবের সম্পৃক্ততা নেই বলে জানান কেরানীগঞ্জ এলজিইডির প্রকৌশলী কাজী মাহমুদুল্লাহ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাজে ঠিকাদারের গাফিলতি ছিল, তাই আমরা তাকে কাজ থেকে বাদ দিয়েছি।’
মুন্সিগঞ্জ সদরে রামপাল এলাকার চাকরিজীবী আবদুল খালেক এই পথে নিয়মিত যাতায়াত করেন। তিনি বলেন, মুক্তারপুর হয়ে ঢাকায় যেতে কম করে আড়াই-তিন ঘণ্টা সময় লাগে। সেখানে মোল্লারহাট ঘাট হয়ে ভেঙে ভেঙে যেতেও লাগে সোয়া এক ঘণ্টা। সেতু হলে এক গাড়িতে করেই ৪০-৫০ মিনিটে যাওয়া যাবে।