অদম্য মেধাবী ২০২৩: পর্ব–৬

এগিয়ে চলার স্বপ্ন ওদের চোখে

অর্থাভাবে বন্ধুদের কাছ থেকে বই ধার নিয়ে পড়েছে সুমাইয়া তাবাসসুম। রিকশাচালক বাবা ও গৃহকর্মী মাকে চাপ না দিয়ে নিজের পড়াশোনার খরচের জন্য অন্যের জমিতে কৃষিকাজ করেছে শাহিন। তবে সুমাইয়া আক্তারের লড়াইটা ভিন্ন। বিয়ের চাপ পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে সে। আর ছোটবেলা থেকে পড়ালেখায় ভালো হওয়ায় প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্ন এগিয়ে নিচ্ছে রিমন।

অদম্য মেধাবী এই শিক্ষার্থীরা এবার দেশের বিভিন্ন বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে। নানা প্রতিকূলতা পাড়ি দিয়ে তারা সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের সবার চোখে স্বপ্ন। কিন্তু আর্থিক অনটনে উচ্চশিক্ষা নিয়ে তাদের মনে আছে দুশ্চিন্তা।

অন্যের বই নিয়ে পড়াশোনা

সুমাইয়া তাবাসসুমের বাবা শামীম আহমেদ পেশায় দিনমজুর। অভাব তাঁদের নিত্যসঙ্গী। মেয়ের পড়ালেখার পেছনে ব্যয়ের সামর্থ্য না থাকলেও তাঁর ইচ্ছা, মেয়ে একদিন পড়ালেখা করে মানুষ হয়ে উঠবে। কিন্তু সুমাইয়া কখনো থেমে থাকেনি। অন্যের দেওয়া বই–খাতা নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে গেছে। শত কষ্টের মধ্যে এবার রংপুর নগরের বড়বাড়ি বয়েজ উদ্দিন স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে সে জিপিএ-৫ পেয়েছে।

সুমাইয়া তাবাসসুম বলে, ‘শীত-গরমে বাবা দিনমজুরি করেন। বাড়িতে ফিরে মজুরির টাকা মায়ের হাতে তুলে দেন। মা সেই টাকা দিয়ে চাল কেনেন। ভালো কিছু খাওয়ার শখ হলেও বাবার কষ্ট দেখে কখনো টাকা চাইনি। বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে বই নিয়েছি।’ শিক্ষকেরাও তাঁর সব সময় খোঁজখবর নিতেন। বিনা বেতনে প্রাইভেট পড়িয়েছেন। তাঁদের দোয়া ও চেষ্টায় জিপিএ-৫ পেয়েছে।

সব বিষয়ে জিপিএ–৫ পেয়েছে সুমাইয়া। এখন সে কলেজে ভর্তি হতে চায়। কিন্তু কলেজে ভর্তির টাকা নিয়ে তার পরিবার দুশ্চিন্তায়। সুমাইয়ার মা লাকী বেগম বলেন, ‘মেয়েটার পড়ার প্রতি খুব ঝোঁক। কলেজে ভর্তির চয়েস দিয়েছে কারমাইকেল কলেজ। এখানে ভর্তি হবার পারলে বাড়ি থাকি কম পয়সায় যাওয়া-আসা করতে পারবে। কিন্তু ভর্তির টাকা কোনটে থাকি জোগাড় হইবে, সেই চিন্তায় ঘুম আইসে না।’

অন্যের জমিতে কাজ করে পড়েছে

শাহিনের বাবা রিপন মিয়া পেশায় রিকশাচালক। মা শাহেনা আক্তার গৃহকর্মীর কাজ করেন। বাবা-মায়ের আয় দিয়েই চলে টানাপোড়েনের সংসার। চার ভাই–বোনের মধ্যে মো. শাহিন মিয়া সবার ছোট। নিজের লেখাপড়ার খরচ মেটাতে অন্যের জমিতে কৃষিকাজ করেছে সে। নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার জনতা উচ্চবিদ্যালয় থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ অংশ নিয়ে সে জিপিএ-৫ পেয়েছে।

শাহিনের মা শাহেনা আক্তার বলেন, ছোটবেলা থেকে তাঁর ছেলে খুব কষ্ট করে পড়াশোনা করেছে। কখনো মানুষের বাসাবাড়িতে কাজ করে, কখনো কৃষিশ্রমিকের কাজ করেছে। স্কুলের শিক্ষকেরাও তাকে বিভিন্ন সময় সহযোগিতা করেছেন।

জনতা উচ্চবিদ্যালয় থেকে পাস করলেও সান্দিকোনা হলি চাইল্ড কিন্ডারগার্টেন অ্যান্ড হাইস্কুলে প্লে গ্রুপ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে শাহিন। ওই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, শাহিন মিয়াকে দারিদ্র্য থামিয়ে রাখতে পারেনি। তাঁরা তাকে লেখাপড়ায় সহযোগিতা করেছেন। কিন্তু এখন তাঁর কলেজে ভর্তি হওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। সহযোগিতা পেলে ছেলেটি অনেক দূর এগিয়ে যাবে।

সুমাইয়ার নিজের সঙ্গে লড়াই

পরিবারের পক্ষ থেকে বারবার সুমাইয়া আক্তারকে বিয়ের জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু জেদের কাছে স্বজনেরা পেরে ওঠেননি। সুমাইয়া পরিবারের সঙ্গে লড়াই করে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে নরসিংহপুর বান্দাইখাড়া উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে। পাশাপাশি তাঁর বিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে সে।

সুমাইয়া আক্তার রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার বাসুপাড়া ইউনিয়নের নরসিংহপুর গ্রামের কৃষক বেলাল হোসেনের মেয়ে। সুমাইয়া জানায়, তার মায়ের মৃত্যুর পর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। লেখাপড়ার খরচ দেওয়ার সামর্থ্য না থাকায় কৃষক বাবা মাঝেমধ্যে মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিতেন। কিন্তু সে বাবার প্রস্তাবে কখনো রাজি হয়নি। অন্যের সহায়তা নিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে গেছে। শিক্ষকেরাও তাকে সহায়তা করেছেন।

প্রকৌশলী হতে চায় রিমন

ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ায় ভালো রিমন। পঞ্চম শ্রেণিতেও বৃত্তি পেয়েছিল সে। বাবা-মায়ের অভাবের সংসারে চেষ্টা করে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে সে। বড় হয়ে সে প্রকৌশলী হতে চায়। ভর্তির সুযোগ পেয়েছে ময়মনসিংহের সৈয়দ নজরুল ইসলাম কলেজে। কিন্তু টাকার অভাবে ভর্তি ও লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

আবদুস সাত্তার ও সালেমা খাতুনের পাঁচ সন্তানের মধ্যে রিমন সবার ছোট। রিমনের বড় ভাই এখলাছ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। টাকার অভাবে লেখাপড়া করতে পারি নাই। আমি একজনের দোকানে কাজ করি। আমাদের পরিবারের মধ্যে সবার ছোট ভাই রিমন কষ্ট করে এসএসসি পাস করেছে।’ রিমনের প্রতিবেশী আবু ছাদেব বলেন, ছেলেটি খুবই কষ্ট করে লেখাপড়া শিখছে। মানুষের একটু সহযোগিতা পেলে অনেক দূর যেতে পারবে।

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, রংপুর; প্রতিনিধি, নেত্রকোনা ও বাগমারা, রাজশাহী]