শ্যামনগরের এই সরকারি পুকুর থেকে পানি নিতে দেড়-দুই কিলোমিটার দূর থেকে নারীরা আসেন। গত বুধবার খলশিবুনিয়া গ্রামে
শ্যামনগরের এই সরকারি পুকুর থেকে পানি নিতে দেড়-দুই কিলোমিটার দূর থেকে নারীরা আসেন। গত বুধবার খলশিবুনিয়া গ্রামে

বিশ্ব পানি দিবস

সংকট কাটল না সুপেয় পানির 

সাধারণত শীতের মৌসুম থেকে বর্ষা আসার আগপর্যন্ত একটা লম্বা সময় এই দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে যেতে হয় এ উপকূলবাসীর।

সাতক্ষীরার সুন্দরবনঘেঁষা উপকূলীয় উপজেলা শ্যামনগর। চারদিকে থইথই করছে পানি। কিন্তু খাওয়ার পানির বড়ই অভাব। খাওয়ার পানি আনতে গিয়ে প্রতিদিন দুবারে ৪-৫ ঘণ্টা ব্যয় করতে হয় এ উপকূলের অধিকাংশ বাড়ির নারীদের। তীব্র গরম পড়ার আগেই শ্যামনগরে খাওয়ার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। গ্রীষ্মের দাবদাহ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই সংকট আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা স্থানীয়দের। 

শ্যামনগরের দাতিনাখালি গ্রামের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নারী কুমিলা রানী মুন্ডা (৩৩)। খাওয়ার পানি আনতে গিয়ে তিনি হারিয়েছেন শিশুসন্তানকে। কুমিলা কষ্টের কথা বলতে গিয়ে বলেন, ‘কাঁখে কলসি আর ঘাড়ে বাচ্চা নিয়ে যাতি হয় জল আনতি। কষ্টের কুথা বুলে বুঝানো যাবে না। ২০২১ সালের এপ্রিলে বাড়িতে সাবাল (ছেলে) রাখে গেলাম খাবার জল আনতি কলবাড়িতে। পানি নে এসে দেখি, বাড়ির ডোবায় ভাসতে আমার আদরের পলাশ। তখন পলাশের বয়স হইলো দুই বছর। সেখান থেকে জল আনতে গেলি ছোট সাবালটা ঘাড়ে করে নে যাই।’

বৃষ্টির অভাব, বন্যায় এলাকায় লবণ পানি ঢুকে যাওয়া এবং পুকুর, জলাধার শুকিয়ে যাওয়ায় আরডব্লিউএইচ ও পিএসএফ ঠিকভাবে কাজ করছে না।
মোস্তাফিজুর রহমান, উপসহকারী প্রকৌশলী, শ্যামনগর উপজেলা জনস্বাস্থ্য বিভাগ

একই গ্রামের রেবেকা খাতুনও (৩৬) পানি আনতে গিয়ে তাঁর শিশুসন্তানকে হারিয়েছেন। তিনি বলেন, ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের এক বিকেলে তাঁর মেয়ে সালমাসহ (৬) কয়েক শিশুকে খেলতে দেখে তিনি পানি আনতে যান। বাড়িতে ফিরে দেখেন, বাড়ির পুকুরে তাঁর মেয়ে ডুবে মারা গেছে। 

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অপরিকল্পিতভাবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন ও লবণাক্ততার সমস্যা দূর করতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো তদারকি না করায় খাওয়ার পানির সংকট বাড়ছে দিন দিন। 

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল শ্যামনগর উপজেলার কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, উপকূলীয় এ এলাকায় ৪০ শতাংশ মানুষ খাওয়ার পানির সংকটে রয়েছে। শ্যামনগর আতরজান মহিলা মহাবিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহী বলেন, উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষদের পান করাসহ দৈনন্দিন কাজের জন্য নির্ভর করতে হয় পুকুর ও বৃষ্টির পানির ওপর। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অনিয়ন্ত্রিত চিংড়ি চাষ, চিংড়িঘেরে উঁচু বাঁধ না দেওয়া, নদীপ্রবাহ আটকে দেওয়া, পুকুর ভরাট, খাল বেদখলের কারণে প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষগুলো নিরাপদ পানির তীব্র সংকটের মধ্য দিয়ে দিনানিপাত করছে। সাধারণত শীতের মৌসুম থেকে বর্ষা আসার আগপর্যন্ত একটা লম্বা সময় এই দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে যেতে হয় এ উপকূলবাসীর।

শ্যামনগর উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় ১ হাজার ৯৪৯টি গভীর (২৫০ ফুটের ওপরে), ৪৯১টি অগভীর (২৫০ ফুটের নিচে), ৫০০টি এসএসটি (৫০ থেকে ১৫০ ফুট) ও ৪৪১টি ভিএসএসটি (৩০ থেকে ৫০ ফুট) নলকূপ রয়েছে। এর মধ্যে ৮টি গভীর, ১২৯টি অগভীর, ১৬টি এসএসটি ও ৪৪টি ভিএসএসটি নলকূপ কয়েক বছর ধরে অকেজো পড়ে আছে। উপজেলার রমজাননগর এলাকার বাসিন্দা আমান উল্লাহ বলেন, খাওয়ার পানির জন্য তাঁকে প্রতি মাসে হাজার টাকার কাছাকাছি ব্যয় করতে হয়। রান্নাবান্নার পানি আনতে হয় অনেক দূর থেকে। বাড়িতে নলকূপ বসিয়েছেন; কিন্তু পানি ওঠে না। 

গত বুধবার সকালে জয়াখালী মোড়সংলগ্ন আকিজ কোম্পানির তৈরি পানির ফিল্টার থেকে পানি নিতে এসেছিল অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী মুর্শিদা। সে জানায়, তাদের বাড়ি সাপখালী। জয়াখালী থেকে তিন কিলোমিটার দূরে। সকাল ৭টার দিকে এলাকার চাচিদের সঙ্গে এখানে পানি নিতে এসেছে সে। তার স্কুল ১০টা থেকে। এখান থেকে গিয়ে স্কুল ধরতে প্রতিদিন তার কষ্ট হয়। তার বাবা দিনমজুর। মা অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। প্রতিদিন পানির জন্য এই পথ পাড়ি দিয়ে তাকেই পানি আনতে হয়। 

রমজাননগর ইউপি চেয়ারম্যান শেখ আল মামুন জানান, এ অবস্থা শুধু কৈখালী ইউনিয়নে নয়, পার্শ্ববর্তী রমজাননগর, ঈশ্বরীপুর, বুড়িগোয়ালিনী, গাবুরা, পদ্মপুকুর, আঠুলিয়াসহ গোটা উপকূলে একই অবস্থা। 

শ্যামনগর উপজেলা জনস্বাস্থ্য বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ভূগর্ভে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় অধিকাংশ নলকূপে পানি কম উঠছে। শুধু দুর্যোগকালে সরকারিভাবে দুর্গতদের মধ্যে খাওয়ার পানি বিতরণ করা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, পানির সমস্যা দূরীকরণে শ্যামনগরে জনস্বাস্থ্য বিভাগের পিএসএফ, আরডব্লিউএইচ (রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং), গভীর ও অগভীর নলকূপ, আরও (রিভার্স অসমোসিস), পুকুর, দিঘি, মার (ম্যানেজড একুইফার রিচার্জ) মিলিয়ে প্রায় আট হাজার পানির উৎস রয়েছে। তবে বৃষ্টির অভাব, বন্যায় এলাকায় লবণ পানি ঢুকে যাওয়া এবং পুকুর, জলাধার শুকিয়ে যাওয়ায় আরডব্লিউএইচ ও পিএসএফ ঠিকভাবে কাজ করছে না। 

মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, কিছু এনজিও পানি সরবরাহের কাজ করলেও জনস্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় না করায় পানি সরবরাহের বিষয়ে কোনো তথ্য তাঁদের কাছে নেই।