কাউয়াদীঘি হাওর

ফুরিয়ে গেছে ‘সোনালি দিন’ 

শুকনা মৌসুমে হাওরে চরে গরু–মহিষ। মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁও ইউনিয়নে কাউয়াদীঘি হাওরে
প্রথম আলো

পায়ে চলা মাটির পথটি দিয়ে কাউয়াদীঘি হাওরপারের গ্রাম আমিরপুরে যাওয়া যায়। ওখান থেকে তিন দিকে গ্রামীণ রাস্তা চলে গেছে। সেখানে দাঁড়িয়ে গ্রামের কয়েকজন কথা বলছিলেন। তাঁরা বলেন, ৩০-৪০ বছর আগে জ্যৈষ্ঠের এ সময় এ এলাকা পানিতে তলিয়ে না গেলেও পানি থই থই করার কথা। নৌকা ছাড়া এ পথ মাড়ানোর আর কোনো উপায় থাকত না। কিন্তু এখন চারদিকের খাল, জমিন শুকনা। কোথাও ব্যাঙের ডাকও নেই।

মৌলভীবাজার সদর ও রাজনগর উপজেলা নিয়ে কাউয়াদীঘি হাওর। আমিরপুর রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁও ইউনিয়নের একটি গ্রাম। গ্রামটি হাওরের একটি অংশে পড়েছে। হাওরটিকে কাছ থেকে দেখেই গ্রামবাসীর বেড়ে ওঠা। গত বৃহস্পতিবার হাওর ঘোরার সময় আমিরপুর গ্রামের রাস্তায় তাঁদের সঙ্গে দেখা। দলে ছিলেন আবদুল জাহির (৮০), জসিম উদ্দিন (৭৫), আবদুল আউয়ালসহ (৫১) বিভিন্ন বয়সের অন্তত ১৫ জন। সন্ধ্যার মুখে শীতল বাতাসে দাঁড়িয়ে হাওর নিয়ে স্মৃতিচারণা করেন তাঁরা। হাওরের বর্তমান অবস্থা নিয়ে তাঁদের কণ্ঠে ঝরে পড়ে হতাশা।

আবদুল জাহির বলেন, ‘২০-২৫ বছর আগেও অনেক মাছ পাওয়া গেছে। তার আগে তো আরও বেশি ছিল। বাড়িঘরের কাছেই মাছ মিলত। ইচা (চিংড়ি) মাছ তো কেউ ধরত না। অনেকে জাল থেকে ফেলে দিত। এখন এক মুইঠ (মুঠ) ইচা মাছ ১০০-২০০ টাকা।’

জসিম উদ্দিন বলেন, কাউয়াদীঘি হাওরে আইড়, রানি, কেদার, পাবদা, বড় চাপিলা—এগুলো এখন পাওয়াই যায় না। সব শেষ।

গ্রামবাসী জানান, আগে হাওরে এত ধান চাষ হতো না। মাছই প্রধান ছিল। হাওরকেন্দ্রিক কিছু আমন ধান হতো, যা ‘কাতারি’ নামেই চিনত সবাই। আশির দশকের প্রথম দিকে মনু নদ প্রকল্প হওয়ার পর থেকে মাছ কমতে থাকে। সেই ধারায় কাউয়াদীঘি হাওর থেকে অনেক মাছ হারিয়ে গেছে। এ প্রকল্পের আগে কুশিয়ারা নদীর সঙ্গে হাওরের সরাসরি সংযোগ ছিল। নদী থেকে হাওরে প্রচুর মাছ ঢুকত। বিশাল সব মাছ। বৈশাখ মাসে বৃষ্টি দিলে নতুন পানির ঢলে ‘উজাইর’ মাছ ধরা ছিল হাওরপারের মানুষের বড় একটি উৎসব।

‘উজাইর’ কী, এমন প্রশ্নের উত্তরে ওই লোকেরা বলেন, বিভিন্ন নালা দিয়ে হাওরে পানি নামা শুরু করলে এই পানি ঠেলে ডিম ছাড়তে ছাড়তে চলে আসত বড় বড় বোয়াল মাছ। ঠেলে উজানের দিকে মাছ উঠত বলে একে ‘উজাইর’ মাছ বলা হয়েছে। দলে দলে মানুষ পলো দিয়ে সেই মাছ ধরতেন। অনেক বছর ধরে আর বৈশাখে ‘উজাইর’ মাছ ধরা হয় না। এ সংস্কৃতি এখন লোপ পেয়েছে।

স্মৃতি হাতড়ে আবদুল জহির আরও বলেন, বৈশাখ মাসেই হাওর পানিতে ভরে গেছে। তলিয়ে গেছে হাওরপারের গ্রাম। প্রায় সব ঘরেই এক-দুইটা নৌকা ছিল। ঘর থেকে পা ফেলতে গেলেই নৌকা লাগত। এখন বন্যা হলে কেবল নৌকা সবার জন্য অপরিহার্য হয়ে ওঠে।

গ্রামের লোকজন আরও বলেন, বর্ষাটা হাওরবাসীর কাছে দুর্ভোগের হলেও উৎসবেরও ছিল। বিভিন্ন বাড়িতে পুঁথিপাঠ, কেচ্ছাকাহিনির আসর বসত। নৌকাবাইচ হতো প্রায়ই। হাওরপারের বিভিন্ন গ্রামে ছোট-বড় নৌকা দিয়ে বাইচ হয়েছে। সারিগান হয়েছে। এখনো হাওর ভরে উঠলে নৌকাবাইচ হয়ে থাকে। হেমন্তে পা-ই ভরসা ছিল। হেঁটেই গন্তব্যে যেতে হয়েছে।

আবদুল আউয়াল বলেন, সবকিছু আর আগের মতো নেই। এই বদল গত ২০-৩০ বছরেই বেশি হয়েছে। হাওরে রাস্তাঘাট হয়েছে, যোগাযোগের সুযোগ বেড়েছে। ধান বেড়েছে, কিন্তু মাছ একেবারেই কমে গেছে। অনেক ধরনের জলজ ফুল-ফল ছিল, তা–ও নেই। প্রচুর পাখিও ছিল। বাড়িঘরে পাখির ডাকে কান পাতা যেত না। হাওর তার প্রকৃতিটাকে হারিয়ে ফেলছে।

কাউয়াদীঘি হাওরপারের মানুষ হাওর রক্ষা সংগ্রাম কমিটি মৌলভীবাজার সদর উপজেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক রাজন আহমদ। তিনি বলেন, বোরোর মৌসুমে ঘোড়া দিয়ে ধান পরিবহন করা হতো। এখন ফসলের মাঠে গাড়ি নিয়ে যাওয়া যায়। এসব রাস্তা–ঘাটের কারণে হাওরের পানিপ্রবাহ স্বাভাবিকতা হারিয়েছে। নৌকা চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ধান কাটার মৌসুমে খোলায় ফেরিওয়ালারা বিভিন্ন ধরনের মিঠাই নিয়ে যেতেন। ধানের বদলে ফেরিওয়ালারা পণ্য বিক্রি করতেন। গত ২০ বছরে তাঁর চোখের সামনেই হাওরের অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। যত দিন যাচ্ছে, ততই হাওর প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য হারাচ্ছে। উজানের অংশে নতুন নতুন অপরিকল্পিত বাড়িঘর নির্মিত হচ্ছে। হাওরের বিস্তৃত পরিধি ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। অনেকে নিয়মনীতি না মেনে হাওরের গভীরে গিয়ে মাছের খামার গড়ে তুলছে। এতে প্রাকৃতিক মাছের মুক্ত জলাশয় সংকুচিত হচ্ছে। অন্যদিকে হাওরের গভীরতা হ্রাস পাচ্ছে।

রাজন আরও বলেন, হাওরের জলজ উদ্ভিদ, প্রাণবৈচিত্র্য ও গতিপ্রকৃতিকে বিবেচনায় নিয়ে চারপাশে বেতজাতীয় বা জলজ বৃক্ষ দিয়ে বেষ্টনী দিতে পারলে উজানের পলি হয়তো আটকে রাখা সম্ভব। এতে হাওরের গভীরতা কিছুটা হলেও রক্ষা পাবে।