খনার বচন বাংলা, আসাম, ওডিশা ছাড়িয়ে ভারতবর্ষের বহু অঞ্চলে কিষানিদের মুখে মুখে ফিরেছে যুগের পর যুগ। ‘গাছের রসে পাতার কষে সকল রোগের ওষুধ আছে’ কিংবা ‘আলো হাওয়া বেঁধো না, রোগে ভুগে মরো না’—এসব ছন্দময় জ্ঞান কেবল একজন কিষানি বা জ্যোতির্বিদ নন, যেন একজন চিকিৎসকের কথাও বলে। ছন্দের আড়ালে হারিয়ে যায় পরিচয়। সেই হারানো স্মৃতি হাতড়াতে চট্টগ্রামে আয়োজন করা হয়েছিল খনার মেলা।
গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের খুলশী এলাকার চিত্রভাষা গ্যালারিতে আয়োজিত হয় ‘খনার মেলা এবং আমাদের এই দেশ-দুনিয়া’ শীর্ষক কথামালা। এতে প্রধান বক্তা ছিলেন শিল্পী কফিল আহমেদ। মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন আলম খোরশেদ, ফেরদৌস আরা আলীম, বাণীব্রত রায়, বদরুন নূর চৌধুরী, মইনুল আলম, রিতু পারভীন প্রমুখ। প্রশ্নে ও গল্পে সেই বিস্মৃত মহীয়সী খনার পরিচয় খোঁজার চেষ্টা করেন বক্তারা। এ সময় অনেকে ছোটবেলায় নানি-দাদির মুখ থেকে শোনা ছড়ার স্মৃতি রোমন্থন করেন। আলোচনা শেষে জনপ্রিয় কিছু খনার বচন নিয়ে গান পরিবেশন করেন জান্নাতুল ঊর্মি, অর্পিতা দেবী, জুডিসিয়াস, তমাল অনার্য, আনা আভেরি, রিমঝিম আহমেদ, আযরাহ দীপান্বিতা, আরিফুল উদয়, রাসেল আহমেদ ও মাহমুদ আলম।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, খনার পরিচয় নিয়ে অনেক রকম কিংবদন্তি প্রচলিত। এর মধ্যে একটি হলো খনা ময়দানবের একমাত্র কন্যা ছিলেন। একদিন রাজ্যে আক্রমণ করে রাক্ষসেরা। ময়দানবকে হত্যা করে সিংহল জয় করে তারা। কিন্তু মায়ায় পড়ে যায় ছোট্ট মেয়েটির। রক্ষকুলের কাছে কৃষি শিখতে থাকেন খনা। তা থেকে খনা আয়ত্ত করেন প্রকৃতি সম্পর্কে নানা জ্ঞান। আবার অনেকের মতে, পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বারাসাত মহকুমার বেড়াচাঁপার দেউলিয়া গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন খনা। তাঁর বাবার নাম ছিল অটনাচার্য। নিজের বচনেই তিনি বলেছেন ‘আমি অটনাচার্যের বেটি, গণতে-গাঁথতে কারে বা আঁটি’। ভারতবর্ষের ইতিহাসে খনা ও খনার বচন এক সুগভীর জ্ঞানচর্চা ও প্রজ্ঞার চিহ্ন বহন করে। যা বলে কৃষি, পরিবেশ, বাস্তুবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা ও চিকিৎসাশাস্ত্রের পারস্পরিক নির্ভরশীলতার কথা, মানুষের মঙ্গলের কথা।
শিল্পী কফিল আহমেদ বলেন, ‘“আলো হাওয়া বেঁধো না, রোগে ভুগে মরো না”—এমন বচন খনা বলে গেছেন হাজারো বছর আগে। তখন এই জ্ঞান মানুষ মেনেছে। এখন আমরা সবকিছু বেঁধে ফেলছি। আলো, হাওয়া, ঘরবাড়ি, এমনকি গঙ্গাকেও। আজকের এই সময়ে এসেও খনা একইভাবে প্রাসঙ্গিক। খনার জিব হারানোর বেদনা যুগে যুগে আমাদের ব্যথিত করে চলছে। খনা ছড়িয়ে আছে সবার মধ্যে। কৃষির সঙ্গে মানুষের জীবনের সঙ্গে খনার জ্যোতিষশাস্ত্রের জ্ঞান জড়িয়ে আছে। প্রকৃতিকে, মাটির চাওয়াকে বুঝতে হলে খনাকে বুঝতে হবে।’