লিবিয়ায় হাত-পা বেঁধে ও মুখে কাপড় গুঁজে বাংলাদেশি এক যুবককে নির্যাতনের ভিডিও স্বজনদের কাছে পাঠিয়েছে একটি মানব পাচার চক্র। সেই সঙ্গে চক্রটি মুক্তিপণ হিসেবে দাবি করছে ১০ লাখ টাকা।
নির্যাতনের শিকার ওই যুবকের নাম রুবেল হোসেন। তাঁর বাড়ি বগুড়ার গাবতলী উপজেলার আমেশ্বপুর নিশিপাড়া গ্রামে। রুবেলের স্ত্রীর বড় বোন আক্তারুনের বাড়ি জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার তেমারিয়া গ্রামে। রুবেলকে লিবিয়ায় পাঠানো দালাল মিজানুর রহমান ওরফে ধলুর বাড়িও তেমারিয়া গ্রামে। দুই মাস আগে দালালের মাধ্যমে লিবিয়ায় যান রুবেল হোসেন।
স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আক্তারুন তাঁর ভগ্নিপতি রুবেল হোসেনকে গ্রামের দালাল মিজানুর রহমান ও তাঁর বাবা আবদুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর রুবেল নিজেই দালাল মিজানুরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। রুবেল তাঁর জমিজমা বিক্রি করে চার লাখ টাকা দালাল মিজানুরের স্বজনদের হাতে দিয়েছিলেন। গত জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে রুবেল লিবিয়ায় পাড়ি জমান। রুবেলের হাত-পা বাঁধা ও মুখে কাপড় গুঁজে লাঠি দিয়ে বেদম পেটানোর ভিডিও ২৭ মার্চ তাঁর এক স্বজনের হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো হয়েছে।
নির্যাতনের শিকার রুবেলের স্ত্রীর বড় বোন আক্তারুন বলেন, রুবেলকে লিবিয়ায় নিয়ে বসিয়ে রেখেছিলেন দালাল মিজানুর। রুবেলকে ভালো কাজ দেওয়ার কথা বলে ১০ দিন আগে লিবিয়ার আরেকটি জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাঁকে আটকে রেখে মারধর করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘অচেনা কণ্ঠের একজন বাংলাদেশি লিবিয়া থেকে আমাকে ফোন করে রুবেলের মুক্তিপণের জন্য ১০ লাখ টাকা চেয়েছেন। তা না দিলে রুবেলকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে। ২৭ মার্চ আমার হোয়াটসঅ্যাপে একটি ভিডিও এসেছে। ভিডিওতে দেখা যায়, একটি ঘরে রুবেলকে আটকে রেখে হাত-পা একসঙ্গে বেঁধে ও মুখে কাপড় গুঁজে লাঠি দিয়ে তাঁকে মারধর করা হচ্ছে। এ সময় রুবেলকে গোঙাতে শোনা যাচ্ছে। এ ঘটনার পর লিবিয়ায় থাকা দালাল মিজানুরকে ফোন করে তাঁকে পাইনি। ঘটনার পর থেকে মিজানুরের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। মিজানুরের বাড়িতে গিয়ে তাঁর মা-বাবাকে বিষয়টি জানানো হয়েছে।’
আক্তারুন বলেন, ‘গতকাল শনিবার সকালে আবারও আমার ছোট বোনের (রুবেলের স্ত্রী) কাছে ফোন করে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ চাওয়া হয়েছে। আমার বোনের স্বামী জমিজমা বিক্রি করে লিবিয়ায় গেছে। এখন আমরা ১০ লাখ টাকা কোথায় পাব?’
গ্রামবাসী ও প্রতিবেশীরা বলেন, দালাল মিজানুর সৌদি আরব গিয়েছিলেন। সেখানে ১০ বছর থাকার পর তিন বছর আগে দেশে ফিরে আসেন। তিনি গ্রামের বাড়িতে মৎস্য চাষ ও মুরগির খামার করেন। দেড় বছর আগে তিনি লিবিয়ায় চলে যান। এরপর মিজানুর লিবিয়ায় লোকজন নিয়ে যেতে শুরু করেন। মিজানুরের বাবা আবদুর রহমান ও ছোট ভাই শাহিন ঘুরে ঘুরে লিবিয়ায় পাঠানোর জন্য লোক সংগ্রহ করতেন। লিবিয়ায় চট্টগ্রামের আনোয়ারার চার তরুণকে নির্যাতনের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর বিভিন্ন স্থানের লোক মিজানুরের বাড়িতে আসতে শুরু করেন। গত মঙ্গলবার দুপুরে ২০-২৫ জন অপরিচিত ব্যক্তি আটটি মোটরসাইকেল নিয়ে মিজানুরের বাড়িতে আসেন। তাঁরা মিজানুরের ছেলে রমিমকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যান। ওই দিন রাতেই স্বজনেরা দৌড়ঝাঁপ করে মিজানুরের ছেলেকে ফেরত নিয়ে আসেন। গত শুক্রবার সকালে বাড়ির মূল ফটকে তালা ঝুলিয়ে মিজানুরের মা-বাবা ও ভাই অজ্ঞাতস্থানে চলে গেছেন।
তেমারিয়া গ্রামের বাসিন্দা ও গোপীনাথপুর ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী সদস্য ফজিলাতুন নেছা বলেন, কয়েক দিন ধরে মিজানুরের খোঁজে লোকজন বাড়িতে আসছেন। ভয়ে মিজানুরের পরিবারের সদস্যরা কেউ বাড়িতে থাকছেন না। মিজানুর অনেক মানুষকে লিবিয়ায় নিয়ে গেছেন। এখন শুনছেন মিজানুর লিবিয়ায় লোকজন আটকে মুক্তিপণ চাচ্ছেন।
তেমারিয়া গ্রামের হাফিজার রহমান বলেন, ‘দুই সপ্তাহ আগে মিজানুর আমার ছেলেকে লিবিয়ায় নিয়ে গেছে। এখন আমরা ছেলের সন্ধান পাচ্ছি না। আমরা সবাই উদ্বিগ্ন।’