পঞ্চগড়ের করতোয়া নদীতে নৌকাডুবিতে এখনো অনেকেই নিখোঁজ আছেন। তাঁদের সন্ধানে নদীতীরে ভিড় করছেন স্বজনেরা। কেউ কেউ নৌকা নিয়ে নদীতে খুঁজে বেড়াচ্ছেন প্রিয়জনকে। কারও হাতে নিখোঁজদের ছবি, তা নিয়ে নদীতীরের বাসিন্দাদের দেখাচ্ছেন আর বিলাপ করছেন। এই দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩০ জনের লাশ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিস। ডুবে যাওয়া নৌকাটির কতজন যাত্রী নিখোঁজ, সে তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। তবে নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনেরা প্রশাসনের কাছে ৬৬ জনের তালিকা দিয়েছেন।
আজ সোমবার সকাল সাড়ে আটটার দিকে করতোয়া নদীর তীরে স্বজনদের খুঁজতে আসেন মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের গেদীপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মহাদেব রায় (৫০)। তিনি বলেন, তাঁর দুই কাকি, মামাসহ আট স্বজন নিখোঁজ। তাঁদের কাউকে খুঁজে না পেয়ে করতোয়ার তীরে বিলাপ করছিলেন তিনি। তাঁর মতো অবস্থা পাঁচপীর গ্রামের জগদীশ রায়েরও। তাঁর এক বন্ধু, বেহাই, ভাতিজি, জামাইসহ ৯ জন নদী পার হচ্ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ভাতিজির লাশ পাওয়া গেছে। কিন্তু অন্যদের সন্ধান পাওয়া যায়নি। করতোয়া পাড়ে এসেছেন তাঁদের খুঁজতে।
প্রিয়জনকে খুঁজে পাওয়ার আশায় জগেশ রায়, প্রদীপ চন্দ্রসহ কয়েকজন নৌকা নিয়ে নদীতে চষে বেড়াচ্ছেন। নিখোঁজদের ছবি নদীতীরের বাসিন্দাদের দেখাচ্ছেন আর বিলাপ করছেন। নিখোঁজদের সম্পর্কে কোনো ধারণাই দিতে পারছেন না দুর্ঘটনাস্থলের তীরের মানুষেরা।
দীপক চন্দ্র রায়ের মা আদুরী রানী ও ছেলে তন্ময় দুজনে মিলে মহালয়ার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে নদী পার হচ্ছিলেন। দুর্ঘটনায় তাঁরাও ডুবে যান। তন্ময়কে উদ্ধার করা গেলেও আদুরী রানী এখনো নিখোঁজ। আজ মাকে খুঁজতে করতোয়ার পাড়ে এসেছে দীপক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘উদ্ধারকারী দলের কোনো তৎপরতা পাওয়া যাচ্ছে না। আমি শুধু মায়ের মুখটা দেখতে চাই। এখানে উদ্ধার দলের কোনো আয়োজনও নেই।’
স্বজনেরা বলেন, তাঁরা নিখোঁজ স্বজনদের মরদেহ যেন বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন, সেই অপেক্ষায় আছেন।
নিখোঁজদের সন্ধানে আজ সকাল থেকে আবারও উদ্ধার কার্যক্রম চালায় রংপুর, কুড়িগ্রাম ও রাজশাহীর ডুবুরি দল। আজ সকালে নদীতে চারটি লাশ ভেসে ওঠে। তাঁদের মধ্যে তিনজন পুরুষ ও একজন নারী। উদ্ধার হওয়া নারীর নাম কবিতা রানী (৫০)। তাঁর বাড়ি মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের ফুটকীবাড়ি এলাকায়।
দিনাজপুর ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক মঞ্জিল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘নৌকাডুবিতে ৬৬ জন নিখোঁজ রয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনরা। আমরা এই তালিকা যাচাই করে দেখছি। পাশাপাশি নদীতে তল্লাশি চালিয়ে যাচ্ছি। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় উদ্ধার কার্যক্রম ভালোভাবেই চলছে।’
স্থানীয়রা জানান, শারদীয় দুর্গোৎসবের মহালয়া উপলক্ষে বোদা উপজেলার মাড়েয়া বাজার এলাকার আউলিয়া ঘাট থেকে শতাধিক মানুষ শ্যালো ইঞ্জিনচালিত একটি নৌকায় করে বড়শশী ইউনিয়নের বদেশ্বরী মন্দিরের দিকে যাচ্ছিলেন। ঘাট থেকে নৌকাটি কিছু দূর যাওয়ার পর দুলতে শুরু করে। এ সময় মাঝি নৌকাটি ঘাটে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে নৌকা ডুবে যায়। যাত্রীদের অনেকেই সাঁতরে তীরে ওঠেন। এ ঘটনার পর পরই স্থানীয় লোকজন উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করেন।
গতকাল দিবাগত রাতে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন পঞ্চগড়-২ আসনের সংসদ সদস্য ও রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের লোকজনের কথা না শুনে এক নৌকায় গাদাগাদি করে নদী পার হতে গিয়ে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। এই ঘটনার জন্য কেউ দায়ী কি না ও প্রশাসনের দিক থেকে কারও কোনো গাফিলতি আছে কি না, তা খুঁজে দেখা হবে।
জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না সবাইকে খুঁজে পাওয়া যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত উদ্ধার অভিযান চলবে। ধারণা করা হচ্ছে, নিখোঁজ যাত্রীরা স্রোতের তোড়ে দূরে ভেসে গেছেন। এ কারণে আশপাশেও খোঁজ রাখছেন তাঁরা।