ক্ষমতার দাপট ২

ভয়ের রাজত্ব কায়েম করেছেন জাহির 

  • জায়গা বিক্রির আগে আবু জাহিরের প্রতিনিধিদের মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে সমঝোতা করতে হয় বলে অভিযোগ।

  • সংসদ সদস্যের স্ত্রী, ছেলে, ভাই, চাচাতো ভাই-বোন দলের বিভিন্ন কমিটির নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে আছেন।

আবু জাহির

আবু জাহির নিজ এলাকাতে যেন এক আতঙ্কের নাম। তিনি হবিগঞ্জ-৩ (সদর, লাখাই ও শায়েস্তাগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য। নিজের মতের বিরুদ্ধে গেলেই প্রতিপক্ষকে হামলা-মামলায় কাবু করেন। তাঁর দলের নেতা-কর্মীরা জানান, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা তো দূরের কথা, নিজ দলের নেতা-কর্মীরা পর্যন্ত নিপীড়ন-হয়রানির ভয়ে তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পান না।

২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিটে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য হন তিনি। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনেও তিনি দলীয় মনোনয়নে সংসদ সদস্য হন। বর্তমানে তিনি হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আলমগীর চৌধুরী থেকে শুরু করে প্রতিটি কমিটিতে পদে থাকা ব্যক্তিরা আবু জাহিরের অনুসারী বলে দলের নেতা-কর্মীরা জানিয়েছেন। এর বাইরে তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে অনিয়ম-দুর্নীতির নানা অভিযোগ।

আবু জাহির হবিগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। দলের নেতা-কর্মীরা ভয়ে তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলেন না।

মতের অমিল হলেই হামলা-মামলা

পরিচয় গোপন রাখার শর্তে পৌরসভার এক বাসিন্দা জানান, ২০১৭ সালে ঈদের জামাতের আগে হবিগঞ্জ কেন্দ্রীয় ঈদগাহে দীর্ঘ সময় ধরে বক্তৃতা করছিলেন আবু জাহির। নামাজের সময় কাছাকাছি চলে আসায় মো. আরব আলী নামের এক ব্যক্তি সংসদ সদস্যকে দ্রুত বক্তব্য শেষ করার অনুরোধ জানান। এরপর সবার সামনে আরবকে শাসান জাহির। নামাজ শেষ হওয়ার পরপরই পুলিশ আসে আরবের বাড়িতে। তবে তাঁকে পায়নি। পরে আরবকে পুলিশ মাদক মামলায় ফাঁসায়। যদিও তিনি পরে সে মামলায় খালাস পান। যেদিন মাদক মামলায় আরব জামিন পান, সেদিনই তাঁর বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় আরেকটি মামলা হয়। এরপর বিভিন্ন অভিযোগে আরও কয়েকটি মামলা হয়।

স্থানীয় দৈনিক প্রভাকর পত্রিকার সাংবাদিক শোয়েব চৌধুরী বলেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনে আবু জাহিরের মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে ২০১৬ সালের ৫ নভেম্বর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন। এ জন্য তাঁর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে চারটি মিথ্যা মামলা করা হয়। গ্রেপ্তার হয়ে তিন মাস কারাগারেও ছিলেন।

এ ছাড়া আবু জাহিরের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করায় স্থানীয় দৈনিক আমার হবিগঞ্জ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক সুশান্ত দাসগুপ্তের বিরুদ্ধেও একাধিক মামলা হয়। সুশান্ত জানান, তিনি এক মাস কারাভোগ করে জামিনে মুক্তি পান।

আওয়ামী লীগের একটি সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের নভেম্বরে জেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় তৎকালীন প্রচার সম্পাদক অনুপ কুমার দেব ওরফে মনা আবু জাহিরের বক্তব্যের একটা অংশের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করেন। এ সময় আবু জাহির প্রকাশ্যে অনুপ কুমারের জিব কেটে ফেলার হুমকি দেন।

এসব অভিযোগের বিষয়ে আবু জাহির বলেন, ‘অযথা হেনস্তা করার কারণই নেই। যাঁরা সাংবাদিকতার নামে সাংঘাতিকতা করে, যাঁরা আমাদের মানসম্মান ক্ষুণ্ন করেন, এঁরা তো আইনের ঊর্ধ্বে নন।’

‘বানরের রুটি ভাগ’

ব্যবসায়িক ঝামেলা মিটিয়ে দেওয়ার কথা বলে আবু জাহির ৫৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন যুক্তরাজ্যপ্রবাসী এক ব্যবসায়ী। গাজীউর রহমান নামের ওই ব্যক্তির অভিযোগ, ২০০৯ সালে শায়েস্তাগঞ্জে তাঁরা দুই ভাই সিএনজি ফিলিং স্টেশনের ব্যবসা শুরু করেন। ওই বছরই ব্যবসায়িক অংশীদার হিসেবে তিনি তাঁর দুই বন্ধুকে যুক্ত করেন।

গাজীউর জানান, একপর্যায়ে একটি বিষয় নিয়ে ওই দুই বন্ধুর সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ হয়। বিরোধ মীমাংসার জন্য তিনি স্থানীয় সংসদ সদস্য আবু জাহিরের দ্বারস্থ হন। এরপর তিনি ‘বানরের রুটি ভাগের’ গল্পের মতো চক্রে পড়েন।

সালিসি বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, লভ্যাংশসহ পুঁজি সংসদ সদস্যের মাধ্যমে ওই দুই বন্ধুকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। টাকা পেয়ে ওই দুই বন্ধু তাঁদের অংশ গাজীউরের নামে হস্তান্তর করে দেবেন বলেও বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়। এ অবস্থায় প্রথম দফায় তিনি ৫৫ লাখ টাকার চেক আবু জাহিরকে দেন। গাজীউরের দেওয়া চেকে সংসদ সদস্য তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী, সন্তান ও ভাইয়ের নামে লিখিয়ে টাকা উত্তোলন করে নেন। ওই টাকা তিনি গাজীউরের দুই বন্ধুকে দেননি।

গাজীউর অভিযোগ করেন, তাঁর বন্ধুদের সংসদ সদস্য টাকা না দেওয়ায় সন্দেহের সৃষ্টি হয়। তাই দুই বন্ধুর পাওয়া বাকি টাকা তিনি দিচ্ছিলেন না। তবে আবু জাহির চাপ দেওয়ায় পরবর্তী সময়ে তিনি আরও ৪টি চেকের মাধ্যমে আবু জাহিরের ছেলে, মেয়ে ও ভাইয়ের নামে ৬৯ লাখ ৫৪ হাজার ৩৬৫ টাকা লিখে দেন। অ্যাকাউন্টে পর্যাপ্ত টাকা না থাকার সুযোগে ওই চেকগুলো ডিজঅনার করিয়ে সংসদ সদস্য তাঁকে বিপাকে ফেলতে স্বজনদের দিয়ে একাধিক মামলা করান। একপর্যায়ে তিনিও তাঁর চেক ফেরত চেয়ে সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করেন।

এ বিষয়ে আবু জাহির বলেন, ‘দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ হয়েছে। আমি বিচার করেছি। তাঁর (গাজীউর) দেওয়া টাকা (৫৫ লাখ) আমার কাছে ছিল। বিচারে যে রায় হয়েছে, সে অনুসারে বাকি টাকা তিনি (গাজীউর) দেননি। গাজীউরের কাছেই ব্যবসায়িক অংশীদারদের টাকা পাওনা আছে।’

জমি বেচাকেনায় কমিশন

হবিগঞ্জ সদর ও শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলায় সাম্প্রতিক কালে অর্ধশতাধিক শিল্পকারখানা চালু হয়েছে। এসব কারখানার জন্য স্থানীয় মানুষেরা জায়গা বিক্রি করেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় পাঁচ ব্যক্তি অভিযোগ করেন, জায়গা বিক্রির আগে তাঁদের আবু জাহিরের প্রতিনিধিদের মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে সমঝোতা করতে হয়। যাঁরা টাকা দেবেন না, তাঁদের পক্ষে জায়গা বেচাকেনা অসম্ভব হয়ে পড়ে।

এ ছাড়া বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের ঠিকাদার, জলমহাল ও বালুমহালের ইজারাদারদের কাজের ভিত্তিতে আবু জাহিরকে টাকা দিয়ে ‘খুশি রাখতে’ হয় বলে অভিযোগ আছে। স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচনী এলাকার যেকোনো উন্নয়নকাজের জন্য সংসদ সদস্যকে ১০ শতাংশ কমিশন দিতে হয়।

এ বিষয়ে আবু জাহির বলেন, ‘যে এসব ছড়াইছে, হেরে কইবায় (বলবে) প্রমাণ দিত।’

সম্পদ বেড়েছে কয়েক গুণ

হলফনামায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সংসদ সদস্য হওয়ার আগে ২০০৮ সালে আবু জাহিরের বার্ষিক আয় ছিল ২ লাখ ৪২ হাজার ৭৯০ টাকা। ২০১৮ সালের হলফনামায় দেখা যায়, দুই দফায় সংসদ সদস্য থাকার পর তাঁর বার্ষিক আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৭ লাখ ৭ হাজার ৯২৬ টাকা। ২০০৮ সালে জাহিরের অস্থাবর সম্পদ ছিল ৩৬ লাখ ২ হাজার ৮০৩ টাকা। ২০১৮ সালে তাঁর অস্থাবর সম্পদ হয়েছে ১ কোটি ৬৫ লাখ ৯২ হাজার ৭৪০ টাকার। ২০০৮ সালে আবু জাহিরের স্থাবর সম্পদ ছিল ৩৫ লাখ ২৩ হাজার টাকার। ২০১৮ সালে তাঁর স্থাবর সম্পদ হয়েছে ২ কোটি ২৩ লাখ ৮৭ হাজার ৭৪৩ টাকার। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আবারও নৌকার মাঝি হতে চান আবু জাহির। তিনিসহ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম কিনেছেন পাঁচজন।

স্থানীয় কয়েকটি সূত্র বলছে, সংসদ সদস্য হওয়ার আগে আবু জাহির পেশায় কর আইনজীবী ছিলেন। সংসদ সদস্য হওয়ার পর তিনি আর আইন পেশায় সক্রিয় নন। তাঁর সম্পদ বহুগুণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি অস্বাভাবিক।

কমিটিতে স্বজনেরা 

স্থানীয় আওয়ামী লীগের তিনজন নেতার সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তবে তাঁরা কেউই নাম প্রকাশ করে বক্তব্য দিতে রাজি হননি। ওই তিন নেতা জানান, জাহিরের স্ত্রী আলেয়া আক্তার জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, ছেলে ইফাত জামিল জেলা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, আপন ভাই মো. বদরুল আলম জেলা যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, চাচাতো বোনের ছেলে আতাউর রহমান ওরফে সেলিম জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সম্পাদক, চাচাতো ভাই আবদুর রহিম জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য এবং চাচাতো ভাইয়ের ছেলে ফয়জুর রহমান ওরফে রবিন জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আছেন।

দলীয় লোকজন জানিয়েছেন, নৌকার মনোনয়নে জাহিরের ভাগনে আতাউর রহমান হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র এবং চাচাতো ভাই আবদুর রহিম হবিগঞ্জ সদর উপজেলার রিচি ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। মূলত সংসদ সদস্যের আত্মীয় হওয়ার কারণেই তাঁরা নৌকার মনোনয়ন পান। এ ব্যাপারে আবু জাহির প্রথম আলোকে বলেন, ‘হবিগঞ্জে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে আমরা আওয়ামী লীগকে দাঁড় করিয়েছি। আমার আত্মীয়স্বজন আওয়ামী লীগ করেন, এটা কি অপরাধ? সবাই তাঁদের যোগ্যতা অনুসারেই কমিটিতে এসেছেন।’

আবু জাহিরের দাবি নাকচ করে দিয়ে জেলা আওয়ামী লীগেরসাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবুল হাসেম মোল্লা বলেন, ‘আবু জাহির জেলায় রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন শুরু করেছেন। তৃণমূলের কর্মীরা তাঁর কাছে উপেক্ষিত। যিনিই তাঁর বিরোধিতা করবেন, তাঁকেই তাঁর প্রতিহিংসার শিকার হতে হবে।’