পাহাড়ের ওপর গাছপালাঘেরা ঘাটলা। বসবার জন্য দুই পাশে রয়েছে সিমেন্টের বাঁধানো বেঞ্চ। ঘাটলা থেকে ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে। কিন্তু সিঁড়ির নিচে কোনো পুকুর বা জলাশয়ের অস্তিত্ব নেই। একেবারে খটখটে শুকনা জায়গায় এসে শেষ হয়েছে শানবাঁধানো ঘাটলার সিঁড়ি।
খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার আমতলী ইউনিয়নের আব্বাস সর্দারপাড়া জামে মসজিদের পাশেই এমন অভিনব ঘাটলা তৈরি হয়েছে। মসজিদ কমিটির সদস্য ও গ্রামবাসীর বক্তব্য, সরকারি প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ করতেই পুকুর দেখিয়ে ঘাটলা নির্মাণ করা হয়েছে এখানে।
আব্বাস সর্দারপাড়া থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে আমতলী আদর্শপাড়া মসজিদ এলাকায় আরও একটি ঘাটলা তৈরি করা হয়েছে পুকুর ছাড়াই। বিষয়টি নিয়ে এলাকাবাসী ক্ষুব্ধ। ঘাটলা নির্মাণ হতে দেখে পানির সমস্যায় ভোগা ওই দুই এলাকার অনেকেই ভেবেছিলেন, পুকুর খনন করা হবে। কিন্তু ঘাটলা নির্মাণের দেড় বছর পার হলেও পুকুর খনন করা হয়নি।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাটিরাঙ্গা উপজেলা কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে পুকুর ও খাল উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্পের অধীনে জিওবির অর্থায়নে ২০২০-২১ অর্থবছরে খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গার আমতলী ইউনিয়নে চারটি পুকুর খনন ও ঘাটলা নির্মাণ করে এলজিইডি। এর মধ্যে ৩৬ লাখ টাকা ব্যয়ে আব্বাস সর্দারপাড়া জামে মসজিদ ও আমতলী আদর্শপাড়া মসজিদের নামে ঘাটলা দুটির নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০২১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি। নির্মাণকাজ শেষ হয় একই বছরের ডিসেম্বরে।
গতকাল রোববার সকালে মাটিরাঙ্গা বাজার থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে আব্বাস সর্দারপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, মসজিদের পাশেই পুকুর ছাড়া নির্মাণ করা হয়েছে ঘাটলা। ঘাটলার পাশেই গৃহবধূ জামিলা বেগমের বাড়ি (৪০)। ঘাটলার সামনে দাঁড়িয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার ৪০ বছরের জীবনে এমন কাণ্ড দেখিনি। ঘাটলা আছে, অথচ পুকুর নেই। সরকারি কাজে এমন চুরি দেখে তাজ্জব লাগে। এ তো সত্যি সত্যি পুকুর চুরি হয়ে গেল।’
আব্বাস সর্দারপাড়া জামে মসজিদের নামে যে ঘাটলা নির্মাণ করা হয়েছে, সেখানে মানুষ যাওয়ার রাস্তা পর্যন্ত নেই। ঘাটলাটি করা হয়েছে পাহাড়ের ওপরে। যেখানে একটি কবরস্থান রয়েছে। মূলত দুই পাহাড়ের মাঝের সরু খাদকে পুকুর দেখিয়ে এখানে ঘাটলা তৈরি করা হয় বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। এ ছাড়া আমতলী আদর্শপাড়া মসজিদের ঘাটলাটিরও একই অবস্থা। ওই ঘাটলায় ওঠারই কোনো পথ নেই। ঘাটলার সামনে পুকুর বলতে কিছুই নেই।
আদর্শপাড়া জামে মসজিদের সভাপতি এমরান হোসেন ও আব্বাস আলী সর্দারপাড়া জামে মসজিদের সভাপতি রুহুল আমীন বলেন, তাঁদের এলাকায় কোনো পুকুর নেই। মূলত সরকারি প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ করতেই এমন ঘাটলা তৈরি করা হয়েছে। দুটি ঘাটলা তৈরির ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮ লাখ করে ৩৬ লাখ টাকা। তবে যা কাজ হয়েছে, তা দুই লাখ টাকার মধ্যেই শেষ করা যায়। বাকি টাকার কোনো হিসাব নেই।
স্থানীয় বাসিন্দা জোসনা বেগম, মো. রবিউল ইসলাম ও রাকিবুল হোসেন বলেন, দুই পাহাড়ের মাঝখানে ঘাটলা তৈরির সময় লোকজন বলেছিলেন, পুকুর খনন করা হবে। তাই আশায় বুক বেঁধেছিলেন সবাই। এখন দেখা যাচ্ছে, সে রকম কিছুই নয়।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের ঘাটলা নির্মাণের কাজ পায় মেসার্স রুবেল এন্টারপ্রাইজ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট কাউকেই খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে তাদের হয়ে কাজ করেছিলেন মাটিরাঙ্গা পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. আলী। তিনি বলেন, কার্যাদেশ দেওয়া কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ এলজিইডি যেখানে দেখিয়ে দিয়েছে, সেখানেই তিনি ঘাটলা তৈরি করেছেন। এর বেশি কিছু বলতে পারবেন না।
তবে এ বিষয়ে বলতে উপজেলা পরিষদের স্থানীয় সরকার প্রকৌশলীর কার্যালয়ে গেলে মাটিরাঙ্গা উপজেলা প্রকৌশলী মো. শাহজাহান কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
মাটিরাঙ্গা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, এমন ঘটনা সত্য হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকারের অর্থ ব্যয়ে অপ্রয়োজনীয় স্থানে কেন ঘাটলা তৈরি করা হলো, তা খতিয়ে দেখা হবে।