গাজীপুরে রেললাইনে নাশকতার ঘটনায় সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আজ রোববার দুপুরে গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনারের কার্যালয় এলাকায়
গাজীপুরে রেললাইনে নাশকতার ঘটনায় সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আজ রোববার দুপুরে গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনারের কার্যালয় এলাকায়

আলোড়ন সৃষ্টি করতে গাজীপুর সিটি কাউন্সিলরের পরিকল্পনায় রেললাইনে নাশকতা: পুলিশ

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর হাসান আজমল ভূঁইয়ার পরিকল্পনায় গাজীপুরের শ্রীপুরে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথে নাশকতার ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. মাহবুব আলম বলেছেন, দলের উচ্চপর্যায়ের নেতাদের চাপ ও দেশে–বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করতে রেললাইনে নাশকতার পরিকল্পনা হয় আজমল ভূঁইয়ার বাড়িতে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী আটজন মিলে রেললাইনের কিছু অংশ কেটে রাখেন।

আজ রোববার দুপুরে গাজীপুর মহানগর পুলিশ (জিএমপি) কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান কমিশনার মো. মাহবুব আলম। এ ঘটনায় বিভিন্নস্থানে অভিযান চালিয়ে সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নাশকতার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নকারী সদস্যরা সবাই বিএনপি এবং তার বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের সাবেক ও বর্তমান নেতা এবং সক্রিয় সদস্য বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।

গ্রেপ্তার সাতজন হলেন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. হাসান আজমল ভূঁইয়া (৫০), জান্নাতুল ইসলাম (২৩), মেহেদী হাসান (২৫), জুলকার নাইন আশরাফি ওরফে হৃদয় (৩৫), শাহানুর আলম (৫৩), মো. সাইদুল ইসলাম (৩২) ও সোহেল রানা (৩৮)। এর মধ্যে আজমল ভূঁইয়া গাজীপুর সদর থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে গত সিটি নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় তাঁকে বিএনপি থেকে আজীবন বহিষ্কার করা হয়েছিল।

পুলিশ জানিয়েছে, জান্নাতুল ও মেহেদী বিএনপির কর্মী। সোহেল রানা গাজীপুরের কাজী আজিম উদ্দিন সরকারি কলেজ ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। শাহীনুর গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ২৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি সভাপতি, হৃদয় ২ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাইদুল গাজীপুর সদর থানা ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি।

প্রসঙ্গত, গত বুধবার ভোরে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথের বনখরিয়া এলাকায় আন্তনগর মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনের সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়। ট্রেনটি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ থেকে ঢাকার কমলাপুরে যাচ্ছিল। মঙ্গলবার রাতের কোনো একসময় গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর ও ভাওয়াল রেলস্টেশনের মাঝামাঝি রেলপথের একটি অংশ কেটে রাখে দুর্বৃত্তরা। এতে ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়ে ১ যাত্রী নিহত ও অন্তত ১২ জন আহত হন।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান গাজীপুরের পুলিশ কমিশনার মো. মাহবুব আলম

সংবাদ সম্মেলনে গাজীপুরের পুলিশ কমিশনার মো. মাহবুব আলম বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এবং তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রথমে জান্নাতুল ইসলামকে (২৩) আটক করা হয়। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গত ১২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় তাঁরা কোনাবাড়ী থেকে ঢাকা যাওয়ার কথা বলে একটি মাইক্রোবাস ভাড়া করেন। তবে ঢাকায় না গিয়ে গাজীপুরের বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাফেরা করতে থাকেন।

আরোহীদের সবাই মুখোশ পরা অবস্থায় ছিলেন। এ অবস্থায় মাইক্রোবাসের চালক ভয় পেয়ে কারণ জানতে চান। তখন একজন মুখোশ খুলে চালককে বলেন, ‘দেখো আমাকে তুমি চিনো কি না?’ চালক তাঁকে চিনতে পেরে আর কিছু বলেননি। ওই গাড়ি নিয়ে তাঁরা রেললাইন কেটে নাশকতা ঘটানোর উদ্দেশ্যে বের হন।

পুলিশ কমিশনার বলেন, পথিমথ্যে তাঁরা বিভিন্ন স্থান থেকে বেশ কয়েকজনকে মাইক্রোবাসে তুলে নেন।

এর মধ্যে তাঁরা গাজীপুর সদর থানার জোড় পুকুরপাড় এলাকার ইবনে সিনহা তোহার বাড়ি থেকে রেললাইন কাটার যন্ত্রপাতি এবং দক্ষিণ সালনার উসমান গণির ভাড়া দেওয়া ‘বাঁশ বাগান রেস্টুরেন্ট’ থেকে দুটি গ্যাস সিলিন্ডার গাড়িতে নেন। তারপরে গাজীপুর শহরের ভেতরে বিভিন্ন অলি–গলিতে ঘোরাঘুরি করে সময়ক্ষেপণ করেন। আনুমানিক রাত সাড়ে ১২টার দিকে তাঁরা ঘটনাস্থল থেকে ৪-৫ কিলোমিটার দূরত্বে বনের পাশে মাইক্রোবাস রেখে হেঁটে সরঞ্জমাদি নিয়ে বনখরিয়া রেলসেতুর পাশে যান। সেখানে গিয়ে তাঁরা একত্রে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন এবং সুযোগ বুঝে আনুমানিক ভোর ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে ২০ ফুট রেললাইন কেটে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন।

রেললাইন কেটে রাখায় গাজীপুরের ভাওয়াল রেলস্টেশনের কাছে বনখরিয়া এলাকায় বুধবার ভোরে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়

জিএমপি কমিশনার আরও জানান, ঘটনা ঘটিয়ে তাঁরা গাড়ি নিয়ে ঢাকায় চলে যান। ঢাকায় গিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাশে চারজনকে নামিয়ে দেন এবং বাকিরা মিরপুরে গিয়ে নামেন।

এরপর অন্য একজনের থেকে মুঠোফোনের মাধ্যমে টাকা নিয়ে মাইক্রোবাসের ভাড়া পরিশোধ করেন।

আটক ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে জিএমপি কমিশনার মাহবুব আলম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, নাশকতার আগে ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও বিএনপির সাবেক নেতা আজমল ভূঁইয়ার বাসাসহ বিভিন্নস্থানে মিটিং হয়। এসব মিটিংয়ে আলোচনা হয় যে দলের উচ্চপর্যায় থেকে বড় কিছু করার চাপ আছে। বড় কোনো ঘটনা ঘটলে দেশ ও বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি হবে। ফলে তাঁরা রেললাইনে নাশকতা ঘটানোর পরিকল্পনা করেন।

মাহবুব আলম বলেন, সরকারের বর্তমান নির্বাচনী কার্যক্রমকে বিতর্কিত করা, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বর্তমানে বিরাজমান রাষ্ট্রীয় সুশৃঙ্খল পরিবেশকে নষ্ট করা, জনমনে ভীতি সঞ্চার করা এবং এর মাধ্যমে দেশ ও বিদেশে ব্যাপক মিডিয়া কাভারেজ, হরতাল-অবরোধ সফল করার জন্য ব্যাপক প্রাণহানির ও ধ্বংসযজ্ঞের জন্য রেললাইনকে বেছে নেওয়া হয়েছিল।