রংপুরের তারাগঞ্জে সবজির দোকানের সামনে দুই ক্রেতা। গতকাল শনিবার বিকেলে
রংপুরের তারাগঞ্জে সবজির দোকানের সামনে দুই ক্রেতা। গতকাল শনিবার বিকেলে

‘বাজার করির আসিয়া সবজির দাম শুনি মাথা ঘোরোছে’

‘বাহে সবজির বাজারোত আগুন নাগছে। আকালি থাকি শুরু করি পটোল, সাতপুতি (ঝিঙে), ভটভটি (বরবটি), বাইগোন (বেগুন), আলু, কচু—কোনোটাতে হাত দেওয়া যাওচে না। সউগগুলার দাম হু হু করি বাড়ে দেছে, তা–ও কায়োতো কিছুই কওচে না। হামার গরিব মাইনষের মরণ ছাড়া বাঁচার কোনো বুদ্ধি নাই।’ গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় রংপুরের বদরগঞ্জ হাটে ঢুকে সবজির বাড়তি দাম শুনে এমন মন্তব্য করেন রিকশাভ্যানচালক আফজাল হোসেন (৪৫)। তাঁর বাড়ি বদরগঞ্জ উপজেলার বাতাসন গ্রামে।

শুধু আফজাল হোসেনেই নন, তাঁর মতো অনেকেই গতকাল বাজারে গিয়ে সবজির বাড়তি দাম শুনে থতমত খেয়েছেন। বদরগঞ্জ রেলস্টেশন পাড়া গ্রামের সোহেল রানা রাতে বাজার পাহারা দেন। মাস শেষে সাকল্যে ৬ হাজার ৫০০ টাকা বেতন পান। স্ত্রী, তিন সন্তানসহ পাঁচ সদস্যের সংসারের তিনিই একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি। গতকাল সন্ধ্যায় বদরগঞ্জ সবজি বাজারে এক কেজি পটোল কিনতে গিয়ে ৫৫ টাকা দাম শুনে দোকানের সামনে থমকে যান সোহেল রানা। তিনি বলেন, ‘চাইর দিন আগোত এক কেজি পটোল কিননু ২৫ টাকায়। আইজ ফির দ্বিগুণের বেশি দাম।’ বাধ্য হয়ে তিনি আধা কেজি পটোল কিনে বাজার থেকে চলে যান।

স মিলে কাজ করেন সহির উদ্দিন (৪৮)। তিনি গতকাল বিকেলে ওই বাজারে এসেছিলেন মরিচ ও আলু কিনতে। দাম শুনে এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে কোনো কিছু না কিনেই ফিরে যাওয়ার সময় সহির উদ্দিন বলেন, ‘দিনে কাজ করিয়া ৩৫০ টাকা পাই। তাক দিয়া এ্যালা দিন চলে না। মাছ–গোশত খাওয়া ভুলি গেছি। বাইগোন, সাতপুতি শাক ছিল হামার ভরসা। সেই শাকসবজির দাম দু-তিন গুণ বাড়ি গেইছে। আগোত সকালে আকালি (মরিচ) টেব্বেয়া লবণ দিয়া পন্তাভাত খাইছেনো, এ্যালা সেটাও আর পারোচি না। কাঁচা আকালির কেজি নাগাইছে ২৭০ টাকা।’

রংপুরের তারাগঞ্জ হাটে গতকাল দুপুরে কথা হয় নারায়ণজন গ্রামের দিনমজুর সাইবুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘মাঠোত কাজ নাই, হাতোত টাকা নাই, বাজার করির আসিয়া সবজির দাম শুনি মাথা ঘোরোছে। ৫০ টাকার নিচোত কোনো সবজি নাই। মাছ–গোশতর মোতোন সবজিও বুজিক গরিবের মুকোত আর চইড়বার নেয়।’

স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, ঊর্ধ্বমুখী নিত্যপণ্যের বাজারে মজুর শ্রেণিসহ নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজন বিপাকে পড়েছেন। বাজারে এসে মিলাতে পারছেন না আয়-ব্যয়ের হিসাব। পরিত্রাণের উপায় খুঁজে না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েছেন তাঁরা। তবে স্থানীয় সবজি ব্যবসায়ীরা বলছেন, টানা বৃষ্টি ও বন্যায় সবজিসহ মসলাজাতীয় পণ্যের উৎপাদন কমে যাওয়ায় বাজারে দাম বেড়েছে।

গতকাল সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বদরগঞ্জ ও তারাগঞ্জের বিভিন্ন সবজির বাজারে ঘুরে দেখা যায়, প্রতি কেজি বেগুন ৬০, পটোল ৫৫, কচুর লতি ৮০, পেঁপে ৪৫, ঝিঙে ৬০, করলা ১২০, কাঁকরোল ৬০, ঢ্যাঁড়স ৫০, মিষ্টিকুমড়া ২০, বরবটি ১০০, শীল আলু ৭০, দেশি সাদা আলু ৬০, কার্ডিনাল জাতের মোটা আলু ৫০ থেকে ৫২ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া প্রতি কেজি আদা ৩৫০, রসুন ২২০, কাঁচা মরিচ ২৭০ ও পেঁয়াজ ১২০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে।

বদরগঞ্জ ও তারাগঞ্জ উপজেলার কয়েকজন সবজি বিক্রেতা বলেন, ছয় দিন আগে প্রতি কেজি বেগুন ৩০, পটোল ৩০, কচুর লতি ৫০, পেঁপে ৩০, ঝিঙে ২০, করলা ৭০, কাঁকরোল ৩৫, ঢ্যাঁড়স ২০, মিষ্টিকুমড়া ১২, বরবটি ৪০, শীল আলু ৫৬, দেশি সাদা আলু ৫২, কার্ডিনাল জাতের মোটা আলু ৪৬ থেকে ৪৮ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এ সময়ে মরিচ বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৬০ থেকে ৭০ টাকায়।

তারাগঞ্জ পাইকারি বাজারে কথা হয় চিকলী গ্রামের ঢ্যাঁড়সচাষি গোলজার হোসেনের সঙ্গে। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘এখান থেকে ৫০ গজ দূরে খুচরা বাজারে ঢ্যাঁড়স ৫০ টাকা কেজি। আর এখানে পাইকারেরা কিনছেন ২৫ থেকে ৩০ টাকায়।’

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের রংপুরের সহকারী পরিচালক বোরহান উদ্দিন বলেন, ভোক্তাদের কাছ থেকে দাম বেশি নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাঁরা প্রতিনিয়ত বাজার মনিটরিং করছেন।