পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নতুন ভবনের নির্মাণকাজ বন্ধ থাকায় কর্মচারীদের জরাজীর্ণ কোয়ার্টারে চলছে অন্তর্বিভাগ ও বহির্বিভাগের চিকিৎসা কার্যক্রম। ১৬ বছর আগে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও নতুন ভবন নির্মাণ শেষ হয়নি। মামলাসংক্রান্ত জটিলতায় থমকে আছে কাজ। অন্যদিকে চিকিৎসকের ১৪টি পদ থাকলেও বর্তমানে ৫ জন দায়িত্ব পালন করছেন।
৯ জুলাই দুপুরে সরেজমিনে দেখা গেছে, কর্মচারীদের তিনটি কোয়ার্টারে অন্তর্বিভাগ, বহির্বিভাগ, জরুরি বিভাগ, ল্যাব ও প্রশাসনিক কাজ চালানো হচ্ছে। একটি কোয়ার্টারে ছয়টি ছোট ছোট কক্ষে ২০টি শয্যা দিয়ে অন্তর্বিভাগ চালু রাখা হয়েছে। শয্যাসংখ্যা কম হওয়ায় রোগীদের স্যাঁতসেঁতে মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়। বৃষ্টি হলে ভবনটির ছাদ চুইয়ে পানি পড়ে মেঝে ভিজে যায়।
চিরাপাড়া গ্রামের ফাতেমা আক্তার (২৩) বলেন, বৃষ্টি হলে ছাদ চুইয়ে পানি পড়ে বিছানা ও শরীরের পোশাক ভিজে যায়।
আরেকটি কোয়ার্টারের তিনটি কক্ষে বহির্বিভাগ ও একটি কক্ষ কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের অল্প জায়গায় ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। এ ছাড়া জরুরি বিভাগ ও ল্যাবের ভবনটির ছাদের পলেস্তারা খসে পড়েছে। জরাজীর্ণ ভবনে জরুরি বিভাগে চিকিৎসা দিতে গিয়ে আতঙ্কের মধ্যে থাকেন চিকিৎসকেরা।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ১৪টি চিকিৎসকের পদ রয়েছে। এর মধ্যে সাতটি পদ শূন্য। বাকি সাতটি পদের মধ্যে দুজন প্রেষণে আছেন আর পাঁচজন দায়িত্ব পালন করছেন। এর মধ্যে কনিষ্ঠ বিশেষজ্ঞ (মেডিসিন), কনিষ্ঠ বিশেষজ্ঞ (সার্জারি), কনিষ্ঠ বিশেষজ্ঞ (অ্যানেসথেসিয়া), ডেন্টাল সার্জন ও সহকারী সার্জনের পদ শূন্য রয়েছে।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা সুব্রত কর্মকার বলেন, আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ও দুজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে সার্বক্ষণিক বহির্বিভাগে, অন্তর্বিভাগ ও জরুরি বিভাগে রোগীদের সেবা দিতে হয়। প্রয়োজনের তুলনায় চিকিৎসক কম থাকায় বহির্বিভাগে রোগী দেখতে গিয়ে তাঁদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। দিনে রোগী দেখে আবার রাতে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে তাঁদের।
উপজেলার নিলতি গ্রামের মো. আলীম (৪০) বলেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় তিনি সেখানে চিকিৎসা পাননি। কয়েক দিন আগে বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজে গিয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন তিনি। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অনেক রোগীকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর বরিশাল ও ঝালকাঠিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
বহির্বিভাগে রোগী দেখতে গিয়ে তাঁদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। দিনে রোগী দেখে আবার রাতে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে তাঁদের।সুব্রত কর্মকার, আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা
হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানান, ৩১ শয্যার হাসপাতাল হলেও ২০ শয্যা দিয়ে আপাতত কাজ চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ভবনসংকটের কারণে ৩১ শয্যা চালু রাখা সম্ভব হয়নি। গত মঙ্গলবার ৬৯ জন পুরুষ ও ১৫৪ জন নারী বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন। অন্তর্বিভাগে ভর্তি ছিলেন ২৫ জন।
স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের পিরোজপুর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৫ সালে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ৩১ শয্যার চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু করে। ২০০৮ সালে ৩১ থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীতকরণের লক্ষ্যে সাড়ে ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। ২০০৮ সালের ২৫ আগস্ট নতুন ভবন নির্মাণের জন্য ‘মেসার্স নূরই এন্টারপ্রাইজ’ নামের বরিশালের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। ওই কার্যাদেশের ১৮ মাসের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ঠিকাদার ২০ শতাংশ কাজ করে তা ফেলে রাখেন। নির্দিষ্ট সময় কাজ শেষ না করায় ২০১৪ সালের ২৫ জুন নূরই এন্টারপ্রাইজের দরপত্রের কার্যাদেশ বাতিল করা হয়। এরপর ২০২২ সালের ২৪ জুলাই ‘মেসার্স কোহিনূর এন্টারপ্রাইজ’ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ২৫ কোটি ১১ লাখ টাকার কার্যাদেশ পায়। এক বছরের মধ্যে ভবনের নির্মাণকাজ শেষ করার কথা ছিল।
২০২৩ সালের ৩১ মে স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী সরেজমিনে দেখতে পান, মাত্র ১৬ শতাংশ কাজ হয়েছে। ওই বছরের ১ জুন তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে কার্যাদেশ বাতিলের সুপারিশ করেন। এরপর মেসার্স কোহিনূর এন্টারপ্রাইজের কার্যাদেশ বাতিল করে নতুন করে দরপত্র আহ্বানের উদ্যোগ নেয় স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। পরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কার্যাদেশ বাতিলের আদেশের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন। বর্তমানে মামলাটি আদালতে বিচারাধীন। ফলে নতুন ভবন নির্মাণের জন্য দরপত্র আহ্বান করা যাচ্ছে না।
স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের পিরোজপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আফসার বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স কোহিনূর এন্টারপ্রাইজ মাত্র ১৬ শতাংশ কাজ করেছিল। কাজের ধীরগতি ও নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করতে না পারায় তাদের কার্যাদেশ বাতিল করা হয়। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি কার্যাদেশ বাতিলের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করে। এ জন্য নতুন ভবনটির কাজের জন্য পুনরায় দরপত্র আহ্বান করা যাচ্ছে না। মামলা নিষ্পত্তি হলে তাঁরা পুনরায় দরপত্র আহ্বান করবেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা সুজন সাহা বলেন, চিকিৎসক–সংকটের কারণে রোগী দেখতে গিয়ে তাঁদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। ভবনসংকট ও চিকিৎসক কম থাকার পরও তাঁরা রোগীদের সাধ্যমতো সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
জেলা সিভিল সার্জন মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সংকটের এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। মামলা নিষ্পত্তি করে দ্রুত নতুন ভবনের কাজ শুরু করার চেষ্টা চলছে।’