ভারী বর্ষণ ও পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে বিলীন কক্সবাজার শহরের কলাতলী সৈকত। আজ সকালে তোলা
ভারী বর্ষণ ও পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে বিলীন কক্সবাজার শহরের কলাতলী সৈকত। আজ সকালে তোলা

কক্সবাজার সৈকতের পাঁচ কিলোমিটার লন্ডভন্ড

কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের কলাতলী পয়েন্ট। আজ মঙ্গলবার সকাল ১০টায় সৈকতে নামার মূল পয়েন্টে নেমে দেখা গেল বিশাল ভাঙন। উত্তর পাশে শামুক-ঝিনুক দিয়ে তৈরি পণ্য বিক্রির অর্ধশতাধিক দোকান। পর্যটকেরা বিকল্প পথে সৈকতে নামছেন। দোকানপাটের বেচাবিক্রিও নেই। অধিকাংশ দোকান বন্ধ। বালুচরে ট্যুরিস্ট পুলিশের একটি চৌকি, তার পাশের একটি ভাঙন সৈকতকে দ্বিখণ্ডিত করে রেখেছে। উত্তাল সৈকতে কেউ যেন গোসলে না নামেন, সে জন্য বালুচরে ওড়ানো হচ্ছে সতর্কতার লাল নিশানা। কয়েকজন পর্যটক নিশানার পাশে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের উত্তাল পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন।

পাশের দোকানের ঝিনুক পণ্য বিক্রেতা আবুল বশর বলেন, গত ১৬ আগস্ট থেকে টানা পাঁচ দিন কক্সবাজারে ভারী বর্ষণ চলে। বৃষ্টির পানিতে পাঁচ শতাধিক হোটেলের কলাতলী হোটেল–মোটেল জোন ডুবে যায়। তখন পাশের পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে জমে থাকা পানি সমুদ্রসৈকতের দিকে নামতে থাকে। এর ফলে বালুচরে বড় বড় ভাঙন দেখা দেয়। এই ভাঙন আজ মঙ্গলবার পর্যন্ত সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তাতে ব্যবসা-বাণিজ্য অচল হয়ে পড়েছে, এই পথ দিয়ে কেউ সৈকতে নামতে পারছেন না।

কলাতলীর উত্তর দিকে সুগন্ধা, সিগাল ও লাবণী পয়েন্টে একই ধরনের আরও তিনটি বড় ভাঙন দেখা গেল। কলাতলী থেকে লাবণী পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটারের সৈকতে ছোট–বড় ভাঙন আছে ১১টির বেশি। তাতে সৈকতের বালিয়াড়ি-সৃজিত সাগরলতার বিলুপ্তি ঘটছে। জোয়ারের পানিতে বালুচর যখন ডুবে যায়, তখন পর্যটকদের হাঁটার জায়গাও থাকে না।

সৈকত দিন দিন সংকুচিত হয়ে পড়ছে জানিয়ে চট্টগ্রামের রাউজান থেকে ভ্রমণে আসা ব্যবসায়ী আমজাদ হোসেন (৫৫) বলেন, সৈকতের এমন দশায় তিনি হতাশ। সৈকত দ্বিখণ্ডিত হয়ে পড়ায় হাঁটার পরিবেশও নেই। সৈকত ময়লা-আবর্জনায় ভরপুর।

সৈকতের বালুচরে রকমারি পণ্য বিক্রির তিন শতাধিক দোকান রয়েছে। পর্যটক না থাকায় বেচাকেনা বন্ধ অধিকাংশ দোকানে। পাশের সুগন্ধা সড়কের কয়েক শ দোকানেরও এমন দশা। বৃষ্টি হলেই দোকানের সামনের সড়কে হাঁটুপানি জমে থাকে।

কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, বৈরী পরিবেশে সাগর উত্তাল, ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের কারণে সৈকতের বিভিন্ন অংশের বালিয়াড়ি বিলীন হচ্ছে। তাতে বিশ্বের দীর্ঘতম সৈকতের সৌন্দর্যহানি ঘটছে যেমন, তেমনি পর্যটকেরা দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। শহরের জলাবদ্ধতার নিরসন, দ্রুত সৈকতের ভাঙনরোধ ও ময়লা-আবর্জনা পরিচ্ছন্নতায় নজর দেওয়া উচিত।

কক্সবাজার চেম্বারের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী আরও বলেন, গত ১৫ জুলাই থেকে ২৬ আগস্ট পর্যন্ত ৪১ দিনে সৈকতের পাঁচ শতাধিক হোটেল-রেস্তোরাঁ, তিন হাজার দোকানপাট, শুঁটকি, মাছসহ পর্যটন খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ১৪টি খাতে ব্যবসায়িক ক্ষতি হয়েছে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ব্যবসায়ীদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।

আজ মঙ্গলবার হোটেল গেস্টহাউস রিসোর্টে পাঁচ হাজারের মতো পর্যটক অবস্থান করছেন জানিয়ে কক্সবাজার হোটেল গেস্টহাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার বলেন, কক্ষ ভাড়ার বিপরীতে সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ ছাড় দিয়েও পর্যটক টানা যাচ্ছে না। যাঁরা আসছেন, তাঁরাও নিরাপদে ঘুরে বেড়ানোর পরিবেশ না থাকায় ফিরে যাচ্ছেন। ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের পানি সড়কের ভরাট নালা দিয়ে নদীতে নামতে না পেরে সৈকতের দিকে নেমে পড়ছে, তাতে বালুচরে ভাঙন দেখা দিয়েছে।

সৈকতে গোসলে নেমে নিখোঁজ পর্যটকদের উদ্ধার তৎপরতায় নিয়োজিত সি-সেফ লাইফগার্ড প্রতিষ্ঠানের সুপারভাইজার সিফাত সাইফুল্লাহ বলেন, সৈকতে ড্রেনেজ–ব্যবস্থা না থাকায় ঢলের পানিতে বালিয়াড়ি বিলীন হচ্ছে। বালুচরে সৃজিত সাগরলতাও হারিয়ে যাচ্ছে। ২০২২ সালে লাবণী পয়েন্টে যখন ভাঙন শুরু হয় তখন পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) প্রায় ৬৮ লাখ টাকা খরচ করে এক কিলোমিটার জিওটিউব ব্যাগ বাঁধ নির্মাণ করেছিল। তাতে কিছুটা ভাঙন রোধ হলেও সৈকতে সুগন্ধা, কলাতলীসহ নতুন এলাকায় ভাঙন দেখা দেয়। সাগরে বালিয়াড়ি বিলীন হওয়ায় গত দুই বছরে কয়েক হাজার ঝাউগাছ উপড়ে পড়েছে। কয়েকটি হোটেল ও শতাধিক দোকানপাট বিলীনের ঝুঁকিতে রয়েছে।

পাউবো কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমদ বলেন, জরুরি ভিত্তিতে সৈকতের ভাঙনরোধে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। সৈকত রক্ষার স্থায়ী সমাধানে বিশেষ একটি প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।