মাদারীপুরের কালকিনিতে দীপাবলি ও কালীপূজা উপলক্ষে প্রায় আড়াই শ বছরের ঐতিহ্যবাহী কুন্ডুবাড়ির মেলা শুরু হয়েছে। মেলা উপলক্ষে উপজেলার ভুরঘাটা বাসস্ট্যান্ড থেকে কুন্ডুবাড়ি পর্যন্ত ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের উভয় পাড়ের প্রায় এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে দোকানপাট বসেছে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শুরু হওয়া এই মেলা চলবে শনিবার রাত পর্যন্ত।
এর আগে স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তির আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে মেলার আয়োজন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল উপজেলা প্রশাসন। এ নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে উভয় পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে তিন দিনের জন্য ঐতিহ্যবাহী এই মেলার অনুমতি দেয় জেলা প্রশাসন। প্রতিবছর কালকিনি পৌরসভা থেকে মেলার ইজারা প্রদান করা হলেও এ বছর ইজারা বাতিল করে ‘টোল ফ্রি’ করেছে পৌরসভা। ফলে কোনো প্রকার চাঁদা ছাড়াই দোকান বরাদ্দ ও বৈদ্যুতিক সুবিধা পেয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
মেলার আয়োজকেরা জানান, হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব দীপাবলি ও কালীপূজা। এই পূজার আয়োজন ঘিরে ১৭৮৩ সালে ভুরঘাটা এলাকার দীননাথ কুন্ডু ও মহেশ কুন্ডু এই মেলার প্রবর্তন করেন। তাই কুন্ডুদের বংশের নামানুসারে এই মেলার নামকরণ করা হয় কুন্ডুবাড়ির মেলা। সেই সময় দীপাবলির পরের দিন এই অঞ্চলের বিভিন্ন কালী প্রতিমা জড়ো করা হতো। এর মধ্যে যাদের প্রতিমা সেরা হতো, তাদের পুরস্কার দেওয়া হতো। সেই সময় চিত্তবিনোদনের জন্য পুতুলনাচ, কবিগান, জারিগান, পালাগান, নৌকা বাইচের আয়োজন করা হতো। কালের বিবর্তনে পালাগান, জারিগান, নৌকাবাইচ বন্ধ থাকলেও নাগরদোলার আয়োজন এখনো রয়েছে। বংশপরম্পরায় প্রতিবছর এই মেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রায় এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে মেলা বসেছে। শুধু কুন্ডুবাড়ি নয়, ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের গোপালপুর থেকে ভুরঘাটা পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে বসেছে শত শত দোকান। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দোকানিরা বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেন। কাঠের বিভিন্ন ধরনের আসবাবপত্রের জন্য এই মেলা বিখ্যাত। মেলায় মাদারীপুর ছাড়াও ফরিদপুর, রাজবাড়ী, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর, বরিশাল, খুলনা, বাগেরহাট, মাগুরা, যশোর, নড়াইলসহ দেশের বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীরা তাঁদের মাটির, বাঁশের ও কাঠের তৈরি বিভিন্ন মালামাল বিক্রির জন্য নিয়ে এসেছেন। প্রতিবছরের তুলনায় এবার কাঠের ফার্নিচারের চাহিদা বেশি রয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
গোপালগঞ্জ থেকে মেলায় ঘুরতে আসা জাকির হোসেন নামের একজন বলেন, ‘দক্ষিণবঙ্গের সর্ববৃহৎ এ মেলা দেখার জন্য দূর থেকে এসেছি। এত বড় মেলা চোখে না দেখলে বিশ্বাস হতো না। সব ধরনের জিনিসপত্র মেলায় রয়েছে।’
৩৫ বছর ধরে মেলায় আসবাবপত্র বিক্রি করে আসছেন সমীর দাশ। তিনি বলেন, ‘ক্রেতাদের চাহিদা বুঝে বিভিন্ন ডিজাইনের আসবাবপত্র মেলায় নিয়ে এসেছি। অনেক কাঠের দোকান বসেছে মেলায়। সবারই টার্গেট কম দামে বেশি পণ্য বিক্রি করার।’
মেলায় অন্তত তিন কোটি টাকার মালামাল বিক্রি হয় বলে জানিয়েছেন আয়োজকেরা। ভুরঘাটার কুন্ডুবাড়ি মেলা কমিটির সভাপতি স্বপন কুন্ডু বলেন, এ বছরও নিত্যপ্রয়োজনী দোকানসহ হরেক রকমের প্রায় পাঁচ শতাধিক দোকান বসেছে। এসব দোকানে ৩ কোটি টাকার বেশি পণ্য বিক্রি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্য বছরগুলোয় ৫ থেকে ৭ দিন এই মেলার আয়োজন হলেও এবার পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনায় ৩ দিনের জন্য মেলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
কালকিনি পৌরসভার প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উত্তম কুমার দাশ প্রথম আলোকে বলেন, পূজা উদ্যাপন কমিটি, সেনাবাহিনী, র্যাব ও পুলিশসহ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে মেলা পরিচালিত হচ্ছে। মেলায় আসা দোকানি, দর্শনার্থীদের সার্বিক নিরাপত্তায় চার স্তরের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে প্রশাসন।