সাময়িক পতিত জমিতে শর্ষেবিপ্লব 

এবার ৪২ হাজার ৫৫০ হেক্টর জমিতে শর্ষে চাষ হয়েছে। গত বছর আবাদ হয় ২৬ হাজার ১৫৬ হেক্টরে।

বাড়ির সামনে শর্ষে মাড়াই করছেন একজন কৃষক। গতকাল দুপুরে গোদাগাড়ী উপজেলার ফুলবাড়ী গ্রামে

রাজশাহীতে এবার শর্ষের ফলনে চাষিরা খুশি। তাঁরা ভালো দামও পাচ্ছেন। এরই মধ্যে ‘বারি সরিষা-১৮’–এর ফলন সবচেয়ে বেশি। দুই বছর ধরে জেলায় শর্ষের আবাদ বাড়ছে। এর মধ্যে বারি সরিষা-১৮–এর আবাদ বেড়েছে প্রায় ১৫ গুণ।

আগে আমন কাটার পরে ও বোরো ধান লাগানোর আগপর্যন্ত বেশির ভাগ জমি পতিত থাকত। এ বছর সেই সাময়িক পতিত জমিতে ব্যাপক হারে শর্ষে চাষ শুরু হয়েছে। দাম ও ফলন ভালো পাওয়ায় চাষিরা বলছেন, ভবিষ্যতে তাঁরা আর জমি ফেলে রাখবেন না।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলায় এবার ৪২ হাজার ৫৫০ হেক্টর জমিতে শর্ষে চাষ হয়েছে। গত বছর এই আবাদের পরিমাণ ছিল ২৬ হাজার ১৫৬ হেক্টর। গত বছর শর্ষের ফলন ছিল প্রতি হেক্টরে ১ দশমিক ৫৬ টন। বিঘায় গড়ে ৫ দশমিক ২ মণ। এবার হেক্টরে ফলন হয়েছে ১ দশমিক ৬২ টন। বিঘায় সাড়ে ৫ মণ হারে ফলন হচ্ছে। এবার জেলায় শর্ষে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৬৮ হাজার ৯৩১ মেট্রিক টন। প্রতি টনে ৪৫০ লিটার তেল ধরে হিসাব করলে দেখা যায়, এবার রাজশাহীতে শর্ষে থেকে স্থানীয়ভাবে ৩ কোটি ১০ লাখ ১৮ হাজার ৯৫০ লিটার তেলের চাহিদা পূরণ হবে। এরই মধ্যে বারি সরিষা-১৮ চাষিদের মধ্যে সাড়া ফেলেছে। গত বছর জেলায় এই শর্ষের আবাদ হয়েছিল মাত্র ৪৭ হেক্টরে। এক লাফে এবার আবাদ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬২৭ হেক্টর। বিঘায় ৮ মণ হারে ফলন হচ্ছে।

বারি সরিষা-১৮ উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক (তৈলবীজ গবেষণা) আবদুল লতিফ (সদ্য পিআরএলে গেছেন)। তিনি বলেন, ‘শর্ষের তেলে কোনো ক্ষতিকারক উপাদান নেই। যুগ যুগ ধরে আমাদের পূর্বপুরুষেরা এই তেল খেয়ে আসছেন। এই শর্ষেতে (বারি-১৮) উপকারী উপাদান লিনোলিক অ্যাসিড (ওমেগা-৬) থাকে ২৪ শতাংশ। আর সাধারণ শর্ষেতে থাকে ১৪-১৫ শতাংশ। আরেকটি উপকারী উপাদান (ওমেগা-৯) থাকে ৫৮ শতাংশ। সাধারণ শর্ষেতে থাকে ১৭-২০ শতাংশ। আবার এই শর্ষের ফলনও বেশি। তবে জীবনকাল একটু বেশি।’

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার ধামিলা গ্রামের চাষি মনিরুল ইসলাম (৩৯) এবার ১০ বিঘা জমিতে শর্ষে চাষ করেছেন। তিনি বলেন, বারি সরিষা-১৮ চাষ করেছিলেন ৫ বিঘায়। বাকি জমিতে বারি সরিষা-১৪ ছিল। ইতিমধ্যে শর্ষে কেটে বোরো ধান রোপণ করেছেন। গত বছর থেকে বারি সরিষা-১৮ চাষ করছেন। নিজে এই শর্ষের তেল খাচ্ছেন। তেলটা পাতলা, ঘ্রাণও ভালো। এবার বাজারে ৩ হাজার ২০০ টাকা মণ দরে শর্ষে বিক্রি করছেন। বারি ১৮ জাতের শর্ষের রং একটু কালো। তাই মণে এক–দেড় শ টাকা কম বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু ফলন বেশি হওয়ার কারণে পুষিয়ে যাচ্ছে। তাঁর মতে, বারি–১৮ জাতের শর্ষের গুণাগুণ সম্পর্কে সবাই এখনো জানেন না। এটা সম্পর্কে ভালো প্রচার হলে দামও বেশি হবে। 

ঈশ্বরীপুর ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা অতনু সরকার বলেন, এই সময়ে কৃষকদের জমিতে শর্ষে চাষ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। তার মধ্যে নতুন জাতের শর্ষে বারি-১৮ বপনের জন্য বেশি উৎসাহিত করেছেন।

গোদাগাড়ী উপজেলার বিজয়নগর গ্রামের কিষানি তাজকেরা বেগম এবার ১০ বিঘা জমিতে শর্ষে চাষ করেছেন। তিনি গত বছর তিন বিঘায় শর্ষে চাষ করেছিলেন। তার মধ্যে এক বিঘা ছিল বারি-১৮ জাতের। এবার তিনি ছয় বিঘা জমিতে বারি-১৮ জাতের ও বাকি চার বিঘায় বারি-১৪ জাতের শর্ষে চাষ করেছেন। তিনি বলেন, বারি-১৮ জাতের শর্ষের ফলন হয়েছে বিঘায় ১০ মণ হারে। শুকিয়ে পেয়েছেন ৯ মণ করে। আবার বীজ হিসেবে ৩ হাজার ৪০০ টাকা মণ দরে বিক্রি করেছেন। অন্য জাতের শর্ষে ৩ হাজার ২০০ টাকা মণ দরে বিক্রি করেছেন।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোজদার হোসেন বলেন, আমন ধান কাটার পর জমি পড়ে থাকত। তেলের ঘাটতি পূরণের জন্য তাঁরা চাষিদের এই সাময়িক পতিত জমিতে শর্ষে চাষে উদ্বুদ্ধ করেছেন। এতে খুব কাজ হয়েছে।