প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন ঘেঁষে মাটিবাহী ট্রাক ও ট্রাক্টরের দাপাদাপি চলে দিনভর। এগুলোর নিচে চাপা পড়ার ভয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ের মাঠে নামেন না। বিদ্যালয়ের আঙিনা, চেয়ার-টেবিল ঢাকা পড়েছে ধুলার আস্তরণে। শব্দদূষণ ও বায়ুদূষণের এই মহোৎসব চলছে নাটোরের সিংড়া উপজেলার ইটালী ইউনিয়নের ইন্দ্রাসন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক নেতার নেতৃত্বে মাটি ব্যবসায়ীদের এই তৎপরতা থামাতে পারছেন না কেউই।
ইন্দ্রাসন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অন্তত ১০ জন শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ১০ দিন ধরে ইটালী ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহাবুর রহমানের নেতৃত্বে স্থানীয় কিছু মাটি ব্যবসায়ী বিদ্যালয়ের মাঠে মাটি বেচাকেনার ব্যবসা করছেন। তাঁরা ১২টি ড্রাম ট্রাক ও ট্রাক্টরে করে এলাকার বিভিন্ন পুকুর থেকে বিদ্যালয়ের মাঠে মাটি এনে রাখছেন। এরপর সেখান থেকে বিক্রি করছেন অন্যদের কাছে। কয়েক দিনের রোদে এসব মাটি শুকিয়ে ধুলাবালি সৃষ্টি হয়েছে। বিদ্যালয় ভবনের ভেতরে ও বাইরে ধুলার স্তর পড়ে গেছে। আসবাবপত্র ও বইখাতা ধুলায় ভরে উঠছে। দিনে কয়েকবার পরিষ্কার করেও ঠিক রাখা যাচ্ছে না। সবচেয়ে বেশি সমস্যা শিক্ষার্থীদের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে। অনবরত ট্রাক-ট্রাক্টর চলাচলের কারণে শিশুরা শ্রেণিকক্ষ থেকে বের হতে পারে না। শিশুরা যাতে শ্রেণিকক্ষ থেকে বের হয়ে মাঠে না আসে সে জন্য মাটি ব্যবসায়ীরা বেত হাতে এক ব্যক্তিকে বিদ্যালয়ের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখেন। তিনি শিশুদের মাঠে নামলে পেটানোর ভয় দেখান।
স্থানীয় লোকজন বলেন, ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহাবুর রহমান, আওয়ামী লীগের কর্মী বজলু মিয়া, মনির হোসেন, সাইফুল ইসলাম ও নাহিদ হোসেন পুকুর খননের চুক্তি নিয়ে এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা গাড়ি প্রতি মাটি বিক্রির প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। তারা ওই গ্রামের অনেকের পুকুর ভরাটের চুক্তি নিয়ে ট্রাক্টরে করে মাটি বিক্রি করছেন।
গতকাল সোমবার দুপুরে বিদ্যালয়টিতে গিয়ে কথা হয় পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী খাদিজা খাতুন, ফারিহা খাতুন ও জান্নাতি খাতুনের সঙ্গে। এই শিশুদের ভাষ্য, ট্রাক্টরের কারণে স্কুলে আসা-যাওয়ার নিয়ে তাদের সমস্যা হচ্ছে। ট্রাক্টরের নিচে চাপা পড়ার ভয়ে থাকছে তারা। বেপরোয়া গতিতে এসব ট্রাক-ট্রাক্টর চলাচল করে। এ ছাড়া ধুলোবালিতে শ্রেণি কক্ষে থাকা খুব কষ্টকর হচ্ছে। তাদের অনেকের শ্বাসকষ্ট ও অ্যালার্জির সমস্যা শুরু হয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে শিক্ষকদের পক্ষ থেকে মাস্ক দেওয়া হলেও সারাক্ষণ মাস্ক পরে থাকতে তাদের ভালো লাগে না।
এ বিষয়ে মাটি ব্যবসায়ী আওয়ামী লীগ নেতা মাহাবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মাঠ ভরাটের জন্য মাটি সরবরাহ করছি। এতে স্কুলের শিক্ষার্থীদের একটু অসুবিধা হতেই পারে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের দিক বিবেচনা করে সবাইকে কষ্ট সহ্য করতে হবে।’
বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক আবদুস সালাম বলেন, তাঁর প্রতিষ্ঠানে ১৫৬ জন শিক্ষার্থী ও পাঁচজন শিক্ষক আছেন। গত কয়েক দিনের ধুলোবালি আর শব্দদূষণের ফলে তাঁরা একরকম বন্দী জীবন যাপন করছেন। ইতিমধ্যে অনেক শিক্ষার্থীরা ধুলার কারণে স্কুলে আসা বন্ধ করে দিয়েছে।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আলী আশরাফ বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে দিয়ে অবাধে ট্রাক্টরে করে মাটি বিক্রির ফলে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার বিঘ্ন ঘটার বিষয়টি তাঁর নজরে এসেছে। এতে যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কাও আছে। বিষয়টি তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন।
সিংড়া উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আল ইমরান বলেন, এই ধরনের মাটিবাহী ড্রাম ট্রাক ও ট্রাক্টরের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।