হিলটন নাথ ভেবে সমাহিত লাশটি আসলে মাহে আলমের

মাহে আলম
ছবি: সংগৃহীত

৭ এপ্রিল ২০২৩। সুন্দরবনে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ হন জেলে হিলটন নাথ। গত ১০ এপ্রিল মোংলা বাজারে যাওয়ার জন্য বের হয়ে আর ফিরে আসেননি ব্যবসায়ী মাহে আলম। ১৩ এপ্রিল সুন্দরবনের করমজল বন্য প্রাণী প্রজননকেন্দ্র থেকে উদ্ধার হয় অর্ধগলিত একটি লাশ। ময়নাতদন্ত শেষে সেই লাশ হস্তান্তর করা হয় হিলটন নাথের পরিবারকে। তবে লাশটি মাহে আলমের বলে পরিবার দাবি করলে বাধে বিপত্তি। ডিএনএ পরীক্ষার উদ্যোগ নেয় পুলিশ।

প্রায় চার মাস পর আসা ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদনে জানা গেল, লাশটি ব্যবসায়ী মাহে আলমের। যাকে অপহরণের অভিযোগে মামলা করেছে পরিবার। হিলটন খ্রিষ্টান ধর্মালম্বী হওয়ায় সেই রীতি অনুযায়ী লাশটি সমাহিত করেছিল পরিবার। পরিচয় শনাক্ত হওয়ার পর মাহে আলমের পরিবার লাশটি উত্তোলন করে ইসলাম ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী দাফনের অনুমতি চায়। হিলটনের পরিবার চাইছে তাঁর সন্ধান।

ঘটনাটি ঘটেছে বাগেরহাটের মোংলা উপজেলায়। ব্যবসায়ী মাহে আলম (৫৭) মোংলা পৌর শহরের বাতেন সড়ক এলাকার মৃত মুন্সি মো. হাবিবুল্লার ছেলে। তিনি মাছের ব্যবসা করতেন। হিলটন নাথ মোংলা উপজেলার চিলা গ্রামের মিটু নাথের ছেলে। তিনি পশুর নদী ও সুন্দরবনে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন।

পরিবারের সদস্যরা জানান, ১০ এপ্রিল সকাল ৯টায় মাহে আলম বাড়ি থেকে বের হয়ে আর ফিরে আসেননি। খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে তাঁর ছোট ছেলে সুমন রানা ১৪ এপ্রিল মোংলা থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। এর মধ্যে মোংলার মামারঘাট এলাকায় থাকা পৌরসভার সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে ১০ এপ্রিল সকালে মাহে আলমকে দেখা যায়। সেই ফুটেজে ট্রলারের মাঝি মোশাররফকে মাহে আলমের হাত ধরে বোটে নিয়ে যেতে দেখা যায়। সে সময় তাঁর পরনে নীল–সাদা প্রিন্টের হাফহাতা শার্ট ও হাতে একটি শপিং ব্যাগ ছিল।

ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অজ্ঞাত মৃতদেহের দাঁত থেকে একজন পুরুষের পূর্নাঙ্গ ডিএনএ প্রোফাইল পাওয়া যায়। পরীক্ষায় সূদৃঢ়ভাবে প্রমাণিত হয় যে অজ্ঞাত মরদেহটি বিথীকা নাথের জৈবিক সন্তানের নয়। অজ্ঞাত মৃতদেহটি সুমন রানার জৈবিক পিতার।

মোশাররফের বিরুদ্ধে মাহে আলমকে অপহরণ করে সুন্দরবনের করমজলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগে মোংলা থানায় মামলা করতে যায় পরিবার। সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে গেলেও থানায় মামলা নেওয়া হয়নি বলে ২৯ এপ্রিল পরিবারের পক্ষ থেকে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করা হয়।

পরে গত ২ মে সুমন রানা বাগেরহাটের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলি আদালত-২-এ থানায় নিয়মিত মামলা হিসেবে গ্রহণের আবেদন করেন। আদালত মোংলা থানাকে ১৫৪ ধারায় এজাহারভুক্ত নিয়মিত মামলা হিসেবে রেকর্ডভুক্ত করার জন্য আদেশ দেন। ওই মামলায় ট্রলারচালক মোশাররফকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সপ্তাহখানেক আগে মোশাররফ জামিনে বের হয়েছেন বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।

আমার বাবাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। তাঁর মরদেহ হিলটনের বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। যা অনেক বড় অপরাধ।
সুমন রানা, মাহে আলমের ছেলে

হিলটন নাথের ভাই সাগর নাথ বলেন, ৭ এপ্রিল তিনি, তাঁর ভাই হিলটন নাথসহ চারজন পশুর নদীতে মাছ ধরছিলেন। রাতে সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) মো. মাহবুব হোসেনের নেতৃত্বে বনরক্ষীরা তাঁদের তিনজনকে বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জ কার্যালয়ে নিয়ে আটকে রাখেন। সেখানে হিলটন ছিলেন না। তাঁর কথা জানতে চাইলে মাহবুব হোসেন বলেছিলেন, পরে আনা হবে। বনরক্ষীরা অনেক মারধর করে পরের দিন সকালে তাঁদের তিনজনকে আদালতে পাঠালেও হিলটনকে পাঠানো হয়নি বলে অভিযোগ সাগর নাথের।

অবশ্য চাঁদপাই রেঞ্জের তৎকালীন সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) মো. মাহবুব হোসেন বলেন, ৭ এপ্রিল তিনি অভিযানে ছিলেন না। তাঁর স্টাফরা অভিযানে ছিলেন। ওই দিন তিনজনকেই আটক করে পরবর্তী সময় আদালতে সোপর্দ করা হয়। কাউকে মারধর বা অন্য কেউ নিখোঁজের ঘটনা ঘটেনি। যাঁদের আটক করা হয়েছিল, তাঁদের সঙ্গে আর কেউ আছেন কি না, তা–ও জানতে চাওয়া হয়েছিল। তাঁরা বলেছেন, তাঁদের সঙ্গে কেউ নেই।

এদিকে ১৩ এপ্রিল রাতে করমজল বন্য প্রাণী প্রজননকেন্দ্র থেকে অর্ধগলিত একটি লাশ উদ্ধার করা হয়। ১৪ এপ্রিল খুলনা মেডিকেল কলেজে ময়নাতদন্ত শেষে নিখোঁজ জেলে হিলটন নাথের পরিবারের সদস্যদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের লাশটি হস্তান্তর করে দাকোপ থানা-পুলিশ। খ্রিষ্টধর্মীয় রীতি অনুযায়ী হিলটনের পরিবার পশ্চিম চিলা গ্রামে ১৫ এপ্রিল মরদেহের শেষকৃত্য করেন। ওই ঘটনায় দাকোপ থানায় হত্যা ও লাশ গুম করার অভিযোগে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করেন হিলটনের মা বীথিকা নাথ।

তাহলে আমার ভাইয়ের কী হলো? আমরা যেকোনো মূল্যে আমার ভাইয়ের মৃতদেহ অথবা জীবিত অবস্থায় আমার ভাইকে ফিরে চাই।
সাগর নাথ, হিলটন নাথের ভাই

এর মধ্যে ছবি দেখে লাশটি নিখোঁজ ব্যবসায়ী মাহে আলমের বলে দাবি করে পরিবার। এর পরিপ্রেক্ষিতে দাকোপ থানা আদালতে ডিএনএ পরীক্ষার আবেদন জানায় তারা। খুলনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের (‘গ’ অঞ্চল) আদেশে ৯ মে ঢাকার সিআইডি ল্যাবে বীথিকা নাথ ও মাহে আলমের ছোট ছেলে সুমন রানা ডিএনএ নমুনা দেন।

১ আগস্ট খুলনার আদালতে এই ডিএনএ প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। গতকাল শনিবার এই প্রতিবেদন পান গণমাধ্যমকর্মীরা। ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাবরেটরির পরীক্ষক মোহাম্মাদ নাজমুল আলম স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অজ্ঞাত মৃতদেহের দাঁত থেকে একজন পুরুষের পূর্নাঙ্গ ডিএনএ প্রোফাইল পাওয়া যায়। পরীক্ষায় সূদৃঢ়ভাবে প্রমাণিত হয় যে অজ্ঞাত মরদেহটি বিথীকা নাথের জৈবিক সন্তানের নয়। অজ্ঞাত মৃতদেহটি সুমন রানার জৈবিক পিতার।

হিলটনের ভাই সাগর নাথ বলেন, ‘(শনিবার) দুপুরের দিকে শুনলাম মাটি দেওয়া মরদেহ আমার ভাই হিলটন নাথের নয়। তাহলে আমার ভাইয়ের কী হলো? আমরা যেকোনো মূল্যে আমার ভাইয়ের মৃতদেহ অথবা জীবিত অবস্থায় আমার ভাইকে ফিরে চাই।’

মাহে আলমকে পরিকল্পিতভাবে খুন করে মরদেহ গুমের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে বিচারের দাবি ছেলে সুমন রানার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বাবাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। তাঁর মরদেহ হিলটনের বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। যা অনেক বড় অপরাধ। আমরা এখন আদালত এবং প্রশাসনের মাধ্যমে বাবার মরদেহ উত্তোলন করে দ্রুত ইসলামী‌ রীতি অনুযায়ী দাফন করতে চাই।’

বিথিকা নাথের করা মামলার তদন্ত করছেন খুলনা পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশনের উপপরিদর্শক (এসআই) মিজানুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মাহে আলমের ছেলে সুমন রানাকে তাঁর বাবার মরদেহ বুঝিয়ে দেওয়া হবে। আর মাহে আলমকে পরিকল্পিতভাবে খুন এবং লাশ গুম করার অভিযোগ থাকলে পরিবারের পক্ষ থেকে পৃথক মামলা করতে হবে।