জামিনে কারামুক্ত হওয়ার পর সাংবাদিক গোলাম রব্বানি ওরফে নাদিম হত্যা মামলার প্রধান আসামি মাহমুদুল আলম ওরফে বাবু বলেছেন, ‘এবারের মাননীয় সংসদ সদস্য মো. নূর মোহাম্মদ সাহেব, উনি অত্যন্ত ভালো লোক। আমার সঙ্গে জেলে অনেকবার কথা হয়েছে। আমার ইউনিয়নের রাস্তাঘাটের কথা বলেছে। বাবু তুমি বের হয়ে আসো, এ মামলা মীমাংসা করে দেব।’
মাহমুদুল আলমের এই বক্তব্যের ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। কারাগার থেকে বেরিয়ে গতকাল বুধবার রাতে জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলার সাধুরপাড়া ইউনিয়নের কেবি মডেল উচ্চবিদ্যালয় মাঠে এই বক্তব্য দেন তিনি। তবে সংসদ সদস্যের দাবি, সাংবাদিক নাদিম হত্যা মামলা মীমাংসার বিষয়ে কারও সঙ্গে কোনো কথা হয়নি।
হাইকোর্ট জামিন আবেদন মঞ্জুর করায় মাহমুদুল আলম গতকাল বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে জামালপুর জেলা কারাগার থেকে মুক্তি পান। এরপর তিনি নিজ কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে নিজ এলাকায় ফেরেন। মাহমুদুল আলম সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাময়িক বরখাস্ত হওয়া চেয়ারম্যান। একই সঙ্গে তিনি সাধুরপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এ হত্যা মামলায় প্রায় এক বছর কারাগারে ছিলেন তিনি। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে তাঁকে চেয়ারম্যান পদ থেকে বরখাস্ত এবং আওয়ামী লীগের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
নিহত সাংবাদিক গোলাম রব্বানি ওরফে নাদিম অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জামালপুর জেলা প্রতিনিধি ও একাত্তর টিভির বকশীগঞ্জ উপজেলার সংবাদ সংগ্রাহক ছিলেন। তিনি ওই উপজেলার নিলক্ষিয়া ইউনিয়নের গোমের চর গ্রামের আবদুল করিমের ছেলে।
ভিডিওতে মাহমুদুল আলমকে বলতে শোনা যায়, ‘১৭ জুন আমি গ্রেপ্তার হয়েছিলাম, পঞ্চগড় আমার নানাবাড়ি থেকে। আপনারা জানেন, এ মামলায় অনেকেই অনেক মন্তব্য করেছেন। ওপরে আল্লাহ তাআলাই জানেন, কে মেরেছে, কে মেরে ফেলেছে। আমার সঙ্গে সাংবাদিকদের অনেক ভালো সম্পর্ক। এটা আপনারা অনেক জায়গায় জানেন। হঠাৎ করে কী কারণে, কী আমার পাপ ছিল আমি জানি না, এ মামলায় রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় আমাকে এক নম্বর আসামি করা হয়েছে। আপনারা জানেন, আমার ছেলে ঢাকার বারিধারায় লেখাপড়া করে। ঢাকা থাকা অবস্থায় তাকেও দুই নম্বর আসামি করেছে।’
তাঁকে আরও বলতে শোনা যায়, ‘এ মামলা বিচারাধীন অবস্থায় আছে, বিচার চলবে। আইনকে আমি শ্রদ্ধা করি। চেয়ারম্যান হওয়ার পর পাঁচ বছরের মধ্যে আমার আড়াই বছর গিয়েছে, আরও আড়াই বছর বাকি আছে। আপনারা তো জানেন, জেলখানা ভালো জায়গা না। দীর্ঘ এক বছর আমি জেলখানায় ছিলাম। আমি এক বছর ধরে আপনাদের কাছ থেকে দূরে ছিলাম। আমি এই এক বছরে আমার অনেক ঘটনাই শুনেছি। অনেক ক্ষতিও হয়েছে। দিনে-দুপুরে ডাকাতি হয়েছে। চুরি করেছে। আমার গরিব লোকের ওপর নির্যাতনও করেছে। টাকাপয়সা খেয়েছে। অনেকের গরু বেচে টাকা নিয়েছে। ছাগল বেচে টাকা নিয়েছে। আমি আইনকে সারা জীবন শ্রদ্ধা করে যাব। জজকোর্ট, ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট, হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট থেকে আমাকে জামিন দিয়েছে। আমরার মামলায় আর কোনো সমস্যা হবে না।’
ভিডিওর শেষের অংশে তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘এবারের মাননীয় সংসদ সদস্য মো. নূর মোহাম্মদ সাহেব, উনি অত্যন্ত ভালো লোক। আমার সাথে জেলে অনেকবার কথা হয়েছে। আমার ইউনিয়নের রাস্তাঘাটের কথা বলেছে। বাবু তুমি বের হয়ে আসো, এ মামলা মীমাংসা করে দেব। আমার বন্ধুবর দুই দুইবারের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, এবার উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হয়েছেন, উনি নজরুল ইসলাম সাত্তার, আমাকে বলেছেন, আমার ইউনিয়নে যা যা প্রয়োজন, সবই করে দেবেন। এক-দেড় বছর আগে আমি চেয়ারম্যান হিসেবে যেমন ছিলাম, আবার আমার ইউনিয়নে চুরি-ডাকাতি, খুন-রাহাজানি যেন বন্ধ করতে পারি।’
মাহমুদুল আলমের বক্তব্যের ব্যাপারে জানতে চাইলে জামালপুর-১ (বকশীগঞ্জ-দেওয়ানগঞ্জ) আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদ আজ সন্ধ্যা ৭টার দিকে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই আসামির সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগই নাই। কথা বলার তো প্রশ্নই ওঠে না। একজন সাংবাদিক হত্যা মামলার আসামির সঙ্গে আমি কেন কথা বলব? তাঁর সঙ্গে আমার কোনো কথা হয়নি।’
এদিকে প্রধান আসামির জামিনে মুক্ত হওয়ার পর উত্তেজনাকর বক্তব্যের বিষয়ে নিহত সাংবাদিক গোলাম রব্বানির স্ত্রী মনিরা বেগম বলেন, ‘স্বামী হত্যার এক বছর পার হয়েছে। প্রধান আসামি জামিনে জেল থেকে মুক্ত হয়েই উত্তেজনাকর বক্তব্য দিচ্ছেন। মামলায় নাকি তাঁর (মাহমুদুল) আর কোনো সমস্যা হবে না। ফলে বিচার পাওয়া নিয়ে সন্দেহ হয়। প্রধান আসামি জেল থেকে বের হওয়ায় আমরা আতঙ্কগ্রস্ত। তাঁর প্রভাবে মামলার অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। এতে আমরা ন্যায়বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছি।’
গোলাম রব্বানির মেয়ে রাব্বিলাতুল জান্নাত বলেন, ‘আমার বাবার হত্যাকাণ্ড সারা দেশের আলোচিত একটা ঘটনা। সারা দেশের সাংবাদিক সমাজসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ প্রতিবাদ করেছিলেন। মামলার প্রধান আসামি জামিন নিয়ে এলাকায় এসেছেন। এতে আমরা পুরো পরিবার আতঙ্কিত। তিনি (মাহমুদুল) প্রভাবশালী—এটা আমরা শুরু থেকেই বলে আসছিলাম। গতকাল রাতের বক্তব্যটিই তার প্রমাণ। জেল থেকে বের হওয়ার পর কতটা ভীতিকর বক্তব্য দিয়েছেন। আমরা চাই তাঁর (মাহমুদুল) জামিন বাতিল করা হোক।’
বাদীপক্ষের আইনজীবী মো. ইউসূফ আলী প্রথম আলোকে বলেন, মামলার এক নম্বর আসামি জামিনে বের হয়েছেন। তাঁর জামিনে মুক্ত হওয়াতে মামলায় প্রভাব বিস্তার করার সম্ভাবনা রয়েছে। শুধু তা–ই নয়, এই মামলার সাক্ষীদেরও তিনি প্রভাবিত করতে পারেন। তার প্রমাণ জেল থেকে বের হয়েই এলাকায় গিয়ে ওই সব বক্তব্য দেওয়া। এতে মামলার ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হতে পারে।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, গোলাম রব্বানি গত বছরের ১৪ জুন রাতে পেশাগত দায়িত্ব পালন শেষে বাড়ি ফেরার পথে বকশীগঞ্জের পাটহাটি এলাকায় সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন। হামলার পরদিন দুপুরে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। হত্যার তিন দিন পর ১৭ জুন নিহত রব্বানির স্ত্রী মনিরা বেগম বাদী হয়ে স্থানীয় থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় মাহমুদুল আলম, তাঁর ছেলে ফাহিম ফয়সাল ওরফে রিফাতসহ ২২ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। পাশাপাশি ২০-২৫ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়। মামলার পর ওই মাসেই মাহমুদুল আলমকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর পর থেকে তিনি কারাগারে ছিলেন।