বঙ্গোপসাগরের মধ্যে ৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্ট মার্টিনে পর্যটকের ঠাঁই হচ্ছে না। কক্সবাজারের টেকনাফের দমদমিয়ার জেটিঘাট দিয়ে দৈনিক ৯টি জাহাজ ও ৫০টির বেশি দ্রুতগতির নৌযান স্পিডবোট ও ট্রলারে যাচ্ছেন অন্তত ৪ হাজার ৫০০ জন পর্যটক। সপ্তাহিক ছুটির দিন বৃহস্পতি ও শুক্রবার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬ থেকে ৭ হাজারে। অর্ধেকের বেশি পর্যটক রাতযাপনের জন্য ওঠেন দ্বীপের ২৩০টির বেশি হোটেল-রিসোর্ট-কটেজে। পর্যটকের অভিযোগ, মানুষের অত্যধিক চাপের অজুহাতে রিসোর্ট ও কটেজমালিকেরা ভাড়া দুই গুণ আদায় করছেন। রেস্তোরাঁর খাবারের দামও অত্যধিক।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় সেন্ট মার্টিনের দক্ষিণ দিকের জেটিতে গিয়ে দেখা গেছে, টেকনাফ থেকে পর্যটক নিয়ে ছেড়ে আসা জাহাজগুলো ভিড়তে শুরু করেছে। সাড়ে ১২টার মধ্যে একে একে ভিড়েছে ৭টি জাহাজ। প্রতিটি জাহাজ থেকে নেমেছেন ৩০০ থেকে ৭০০ পর্যটক।
জেটির ইজারাদারের লোকজন জানান, বৃহস্পতিবার অন্তত ছয় হাজার পর্যটক এসেছেন। আজ শুক্রবার আসতে পারেন অন্তত সাত হাজার। অর্ধেক পর্যটক রাতযাপনের জন্য সেন্ট মার্টিনে থেকে যাবেন। অবশিষ্ট ব্যক্তিরা বিকেল তিনটা থেকে জাহাজে আবার টেকনাফ ফিরে যাবেন।
জেটিঘাটে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, বৃহস্পতি ও শুক্রবার পর্যটকের সংখ্যা কিছুটা বাড়ে। অন্যান্য দিন আসেন চার হাজারের মতো পর্যটক। অর্ধেক থাকেন, অর্ধেক চলে যান। একসঙ্গে কয়েক হাজার পর্যটকের রাতযাপনের ব্যবস্থা দ্বীপে নেই।
হোটেলকক্ষের দ্বিগুণ ভাড়া এবং রেস্তোরাঁগুলোর খাবারের অতিরিক্ত দাম আদায় প্রসঙ্গে ইউপি চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, ৯৫ শতাংশ হোটেল–রেস্তোরাঁ মালিক ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার প্রভাবশালী। তা ছাড়া সেন্ট মার্টিনে কিছু নেই। মাছ, মাংস, তরিতরকারিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছু ট্রলারে বোঝাই করে আনতে হয় ৩৪ কিলোমিটার দূরের টেকনাফ থেকে। এ জন্য খাবারের দাম কিছুটা বেশি।
সেন্ট মার্টিন জেটিঘাট থেকে বড়বাজার হয়ে বিএন ইসলামিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ পর্যন্ত দ্বীপের প্রধান সড়কটির দুই কিলোমিটারজুড়ে পর্যটকের গিজগিজ অবস্থা, সড়কে পা ফেলার জায়গা নেই। পর্যটকদের এদিক-সেদিক নিয়ে যাওয়ার জন্য সড়কে থাকে শত শত ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা (টমটম)। দ্বীপের পূর্ব-উত্তর ও পশ্চিম দিকের সৈকতেও পর্যটকের ভিড়। দ্বীপের সড়ক-উপসড়কে হাঁটছেন অনেকে।
দ্বীপের পশ্চিম পাশের সৈকতঘেঁষে তৈরি হয়েছে তিনতলার হোটেল দ্য আটলান্টিক। হোটেলে কক্ষ আছে ৫২টি। সব কটি পর্যটকে ভরপুর। হোটেলের ব্যবস্থাপক আমজাদ হোসেন বলেন, প্রতিটা কক্ষের ভাড়া ৭ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা। অতিরিক্ত ভাড়া আদায় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সব সময় এ রকম ভাড়াই তাঁরা আদায় করেন সৈকত তীরের ভালো মানের হোটেল বলে।
দ্বীপের অত্যাধুনিক তিনতলার হোটেল ব্লু মেরিনে কক্ষ আছে ৪১টি। সব কটিতে অতিথি আছেন। ভাড়া ৬ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা। হোটেলের ব্যবস্থাপক জাকির হোসেন বলেন, অনলাইনে ঢাকা থেকে কক্ষভাড়া বুকিং করা হয়। ভাড়া দেখেই পর্যটকেরা হোটেল ওঠেন। এ কারণে কেউ অভিযোগ তোলেন না। বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবার অতিথির চাপ থাকে বেশি।
পাশের প্রাসাদ প্যারাডাইস, সীমানা পেরিয়ে, হোটেল অবকাশ, পান্না রিসোর্ট, কিংসুক, ডিমাস প্যারাডাইস, নীল দিগন্তসহ শতাধিক হোটেলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানেও অতিথিতে ঠাঁসা। কক্ষ খালি নেই। ভাড়া আদায় হচ্ছে ৩ হাজার থেকে ৯ হাজার টাকা।
দেখা গেছে, দ্বীপের যেখানে–সেখানে গড়ে ওঠা কোনো হোটেলে মূল্যতালিকা নেই। রেস্তোরাঁগুলোর খাবারের দাম টানানো থাকে না। ভাড়া ও খাবারের মূল্য আদায় হয় ইচ্ছামতো। ভ্রমণনিষিদ্ধ গলাচিপা ও দক্ষিণপাড়ায় নির্মিত কয়েকটি রিসোর্টের ভাড়া আদায় হচ্ছে ৯ থেকে ১৮ হাজার টাকা। নির্জন এলাকার রিসোর্টগুলোতে তরুণ-তরুণীদের ভিড় বেশি। হোটেল ভাড়া ও রেস্তোরাঁর খাবার দাম নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের তৎপরতা নেই।
দুপুরে দ্বীপের পূর্ব দিকের কোস্টগার্ড সড়কে হোটেল খুঁজছিলেন ঢাকার মগবাজার থেকে ভ্রমণে আসা চারটি পরিবার। এ সড়কের হোটেল সানরাইজে ২৭টি, বি ব্লু ইস্টার্নে ও সি ফাইন্ড রিসোর্টের ৩৬টি কক্ষের কোনোটি খালি নেই। একটি পরিবারের প্রধান ও মগবাজারের ঠিকাদার আহমদ হোসাইন বলেন, ‘সেন্ট মার্টিনের এমন পরিস্থিতি কল্পনা করিনি। দ্বীপের কোথাও রাত কাটানোর হোটেল মিলছে না।’
ঢাকার মিরপুর থেকে আসা পর্যটক হামিদুর রহমান বলেন, পরিবারের ১২ জন সদস্য নিয়ে তিনি বুধবার সেন্ট মার্টিনে ভ্রমণে আসেন। ওঠেন একটি রিসোর্টে। কক্ষভাড়া গুনতে হচ্ছে ৮ হাজার টাকা করে, যা আগে ছিল ২ হাজার টাকা।
রাজশাহীর ব্যবসায়ী গোলাম কিবরিয়া স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে ওঠেন পশ্চিম সৈকতের একটি ইকো রিসোর্টে। কক্ষভাড়া ১২ হাজার টাকা গুনতে হচ্ছে জানিয়ে গোলাম কিবরিয়া বলেন, কক্সবাজার কিংবা ঢাকার পাঁচ তারকা হোটেলের ভাড়াও এত না। পাশে সমুদ্র আছে বলেই পর্যটকেরা অতিরিক্ত ভাড়া দিয়েও রাত কাটাতে চাইছেন।
সেন্ট মার্টিন হোটেল রিসোর্ট মালিক সমিতির সভাপতি আবদুর রহমান বলেন, ১৩ জানুয়ারি থেকে টেকনাফ থেকে জাহাজে চড়ে সেন্ট মার্টিন ভ্রমণের সুযোগ পাচ্ছেন পর্যটকেরা। এর আগে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম থেকে একাধিক জাহাজে কিছু পর্যটক আসেন। আগামী ১৫ মার্চ পর্যন্ত পর্যটকের আগমন ঘটবে। এ কারণে হোটেলভাড়া কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। কক্ষভাড়ার তালিকা প্রসঙ্গে আবদুর রহমান বলেন, অধিকাংশ হোটেল, রিসোর্ট ও কটেজ সেন্ট মার্টিনের বাইরের লোকজনের। অনেক টাকাপয়সা খরচ করে তাঁরা হোটেল বানিয়েছেন, ভাড়াও তাঁরা নির্ধারণ করেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর করার কিছু নেই।