নোয়াখালী- বর্জ্য পোড়ানোর ধোঁয়ায় চোখ জ্বালাপোড়া করে, দুর্গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে আশেপাশের বাসিন্দাদের। সম্প্রতি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের চৌমুহনী চৌরাস্তা এলাকায়
নোয়াখালী- বর্জ্য পোড়ানোর ধোঁয়ায় চোখ জ্বালাপোড়া করে, দুর্গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে আশেপাশের বাসিন্দাদের। সম্প্রতি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের চৌমুহনী চৌরাস্তা এলাকায়

দুর্গন্ধ ও ধোঁয়ায় সারা বছরই অসুস্থ থাকে যে এলাকার মানুষ

গৃহিণী শাহীন আক্তার (৪৫) কোলে থাকা এক বছর বয়সী নাতির পায়ের খোসপাঁচড়া দেখিয়ে বলেন, সারা বছরই এ রকম খোসপাঁচড়া লেগে থাকে। থাকে সর্দিকাশি, শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগ। মাসের পর ওষুধ খাইয়েও কোনো কাজ হয় না। মাঝেমধ্যে একটু কমে, তবে কিছুদিন পর আবার দেখা দেয়। শুধু শিশুরাই নয়, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার চৌমুহনী পৌরসভার চৌরাস্তা এলাকার খালপাড়ের বাসিন্দাদের প্রতিনিয়ত এমন নানা অসুখ-বিসুখের সঙ্গে লড়াই করতে হয়। পৌরসভার বর্জ্য পোড়ানোর বিষাক্ত ধোঁয়া এবং পুকুরে ছড়িয়ে পড়া ময়লা পানির কারণে এমন দুর্ভোগ নেমে এসেছে ওই এলাকার কয়েক শ পরিবারে।

সম্প্রতি চৌরাস্তা খালপাড় এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নোয়াখালী-কুমিল্লা আঞ্চলিক মহাসড়ক ঘেঁষে বিশাল বর্জ্যের স্তূপ। স্তূপজুড়ে জ্বলছে মৃদু মৃদু আগুন। চারদিক ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। আশপাশের বাতাসে তীব্র দুর্গন্ধ। পাশ দিয়ে চলাচল করা খুবই দুরূহ। বেশির ভাগ পথচারী হাঁটছেন নাক চেপে। এ এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিটি পরিবারেই রয়েছে বয়স্ক নারী-পুরুষ এবং শিশুসহ নানা বয়সী মানুষ। তাদের অনেকেই নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছে ধোঁয়ার কারণে। বর্জ্যের স্তূপ থেকে চুইয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে পাশের ডোবায়। ওই ডোবার পানি ব্যবহার করা হয় গোসল, কাপড় ধোয়া ও রান্নাবান্নায়। আর এ কারণে পেটের অসুখ, খোসপাঁচড়াসহ নানা ধরনের অ্যালার্জি লেগে থাকে সারা বছর।

গৃহিণী শাহীন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, বর্জ্যের দুর্গন্ধে ঠিকমতো খেতেও পারেন না। খাবার খেতে বসলে বমি আসে। যখন আগুন দেওয়া হয়, তখন ধোঁয়ায় ঘরদুয়ার অন্ধকার হয়ে যায়। শ্বাস নিতে পারেন না। কাশি ও শ্বাসকষ্ট লেগেই থাকে। ওষুধেও কাজ করে না। জন্ম থেকেই এখানে বসবাস করছেন, অন্য কোথায়ও যাওয়ার জায়গাও নেই। এলাকার হয়রানির ভয়ে প্রতিবাদও করেন না কেউ।

একই এলাকার আরেক গৃহিণী পারুল বেগম বলেন, দুর্গন্ধ ও ধোঁয়ায় নিশ্বাস নিতে পারেন না। দম বন্ধ হয়ে আসে। জ্বর, সর্দিকাশি থাকে সারা বছর। একই সমস্যার কথা জানান পারুলের প্রতিবেশী নাজমা আক্তারও। তিনি বলেন, ‘আমরা গরিব বলে কোথায়ও যাওয়ার জায়গা নেই। বাপ-দাদা থেকে এখানে আছি। বর্জ্যের দুর্গন্ধে এবং বিষাক্ত ধোঁয়া আমাদের জীবনকে বিপন্ন করে তুলেছে।’

খালপাড় থেকে বসতি সরিয়ে এখন ভালো আছেন বেলাল হোসেন (৫৮)। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, তিনি দেশ স্বাধীনের পর থেকে এই খালপাড়েই বসবাস করেছেন। বর্জ্য পোড়ানোর দুর্গন্ধে শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। পরে বাধ্য হয়ে তিনি পায় দুই বছর আগে এই এলাকা ছেড়ে অন্য জায়গায় বাড়ি করেছেন। এখন অনেকটা সুস্থ আছেন। বেলাল হোসেন বলেন, বর্জ্য পোড়ানোর ধোঁয়া ও দুর্গন্ধে খালপাড়ের প্রায় ৩০০ পরিবার প্রতিনিয়ত দুর্বিষহ দিন পার করছে।

বর্জ্য পোড়ানোর ধোঁয়া ও দুর্গন্ধ পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর বলে মন্তব্য করেছেন নোয়াখালীর আবদুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদুন্নবী। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, বিষাক্ত ওই ধোঁয়া জনস্বাস্থ্যের জন্য খুবই হুমকি। কারণ, ওই ধোঁয়া বাতাসের সঙ্গে আশপাশে ছড়িয়ে পড়ার কারণে ওই এলাকায় বসবাসকারীদের শ্বাসকষ্ট, সর্দিকাশিসহ নানা রোগ দেখা দিতে পারে। তা ছাড়া বাতাসে ছড়িয়ে পড়া জীবাণু শারীরিক বিভিন্ন সমস্যা তৈরি করতে পারে।

বিষয়টি নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে চৌমুহনী পৌরসভার মেয়র খালেদ সাইফুল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, পৌরসভার নিজস্ব জায়গা না থাকায় এবং সরকারি বরাদ্দ না থাকায় স্থায়ীভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কোনো উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে বাধ্য হয়ে সড়কের পাশের সরকারি জায়গায় বর্জ্য ফেলা হয় এবং কয়েক দিন পরপর আগুন দিয়ে সেগুলো পুড়িয়ে ফেলা হয়। তাঁরা চেষ্টা করছেন স্থায়ীভাবে এই সমস্যার সমাধান করতে। এ জন্য কিছুটা সময় লাগবে।