১৫ বছর ধরে ঘুরে ঘুরে সুস্বাদু কাউনের চাল বিক্রি করেন তিনি

পঞ্চগড় বাজার জামে মসজিদ মার্কেটসংলগ্ন একটি ফলের দোকানের সামনে বসে কাউনের চাল বিক্রি করছেন আরশেদ আলী। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে
ছবি: রাজিউর রহমান

বড় একটি গামলার মধ্যে রেখেছেন উত্তরাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী কাউনের চাল। ছোট্ট প্লাস্টিকের টুলে বসে দাঁড়িপাল্লায় চাল মেপে ক্রেতাদের দিচ্ছেন এক বৃদ্ধ। পাশে একটি বড় ব্যাগেও রাখা আছে চাল। এরই মধ্যে কেউ কেউ এসে কাউনের চালের দাম জানতে চাচ্ছেন। আবার কেউবা কিনেও নিচ্ছেন আধা কেজি থেকে এক কেজি পর্যন্ত।

বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে পঞ্চগড় বাজার জামে মসজিদ মার্কেটসংলগ্ন একটি ফলের দোকানের সামনে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে। যিনি কাউনের চাল বিক্রি করছিলেন, তাঁর নাম আরশেদ আলী (৬৮)। প্রতি কেজি কাউনের চাল ১৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছিলেন তিনি। স্থানীয় লোকজনের কাছে কাউনের চাল বিক্রেতা হিসেবে বেশ পরিচিত তিনি। প্রতিদিনই জেলার ছোট-বড় বিভিন্ন হাটবাজার ঘুরে কাউনের চাল বিক্রি করেন। ১৫ বছর ধরে কাউনের চাল বিক্রি করে চলছে তাঁর সংসার।

আরশেদ আলীর বাড়ি পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার কাজলদীঘি-কালিয়াগঞ্জ ইউনিয়নের তেলিপাড়া এলাকায়। নিজের আবাদি কোনো জমি নেই। বসতভিটার ১০ শতক জমিতে দুই ছেলেসহ বসবাস করেন। তাঁর দুই ছেলেকেই বিয়ে দিয়েছেন। বড় ছেলে তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে আলাদা সংসার করছেন। এখন স্ত্রী, ছোট ছেলে, ছোট ছেলের স্ত্রী ও এক মেয়েকে নিয়ে পাঁচজনের সংসার তাঁর। ছোট ছেলেকে নিয়ে অন্যের দুই বিঘা জমি বর্গা নিয়েও আবাদ করেছেন আরশেদ আলী।

আলাপকালে আরশেদ আলী বলেন, আগের দিনে গরিব মানুষ কাউনের ভাত খেয়েই থাকত। এখন কাউন পাওয়াই যায় না। যে অল্প পরিমাণে কাউন পাওয়া যায়, তার দামও বেশি। এ জন্য এখন যাঁরা কাউন কেনেন, তাঁরা শখ করে খাওয়ার জন্যই কেনেন। ১৫ বছর আগে যখন কাউনের চাল বিক্রি শুরু করেছিলেন, তখন প্রতি কেজি ছিল ৪০ টাকা। ওই সময় প্রতি মণ কাউন কিনতেন ৪০০ টাকা দরে। দাম বাড়তে বাড়তে এখন প্রতি কেজি চাল বিক্রি করতে হচ্ছে ১৮০ টাকা। এখন আবাদ কমে যাওয়ায় কয়েকটা বাজার ঘুরে এক মণ কাউন কিনতে হয় ১ হাজার ৮০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৯০০ টাকায়। তা-ও বাজারে কাউন খুঁজে পাওয়া কঠিন। এক মণ কাউন কিনে শুকিয়ে মিলে (চালকলে) চাল করে নেওয়ার পর ২৩ থেকে ২৪ কেজি চাল পাওয়া যায়। প্রতি কেজি কাউন চাল করতে মিলের মালিককে দিতে হয় ৪ টাকা করে।

সময়ের বিবর্তনে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা আর কৃষিব্যবস্থার উন্নতির সঙ্গে হারিয়ে যেতে শুরু করে কাউনের আবাদ। ফলে কাউন এখন গরিবের নয়, ধনীদের বিলাসী ও শৌখিন খাবারে পরিণত হয়েছে।

আগে দিনমজুরের কাজ করতেন আরশেদ আলী। ২০০৮ সালে আরমান আলী নামে তাঁর এক ভগ্নিপতি (বোনের স্বামী) ঢাকায় একটি বাসার তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কাজ করতেন। ওই সময় তিনি ঢাকায় কাউনের চাল ভালো দামে বিক্রি হতে দেখেছিলেন। পরে তিনি একদিন বাড়িতে এসে তাঁকে বিষয়টি জানান। তাঁর এলাকায় তো কাউনের দাম কম, কিন্তু ঢাকায় এই চালের চাহিদা অনেক বেশি। ঢাকার মানুষ কাউনের পায়েস খান। ঢাকায় কাউনের চাহিদার কথা জেনেই স্থানীয় বাজারে ঘুরে ঘুরে এক মণ কাউন কিনেছিলেন। পরে নানা জটিলতায় শেষ পর্যন্ত আর ঢাকায় কাউন পাঠাতে পারেননি। তখন থেকেই কাউনের চাল কেনাবেচার পেশায় জড়িয়ে পড়েন তিনি।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশের উত্তরের এ জনপদে এক সময় কাউন বেশ পরিচিত ও সুস্বাদু খাবার হিসেবে বিবেচিত হতো। সে সময় কাউনের আবাদও বেশি করতেন কৃষকেরা। প্রায় ২০ বছর আগে গরিব-অসহায় মানুষের সাধারণ চালের ভাতের অভাব পূরণ করত কাউনের ভাত। তবে সময়ের বিবর্তনে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা আর কৃষিব্যবস্থার উন্নতির সঙ্গে হারিয়ে যেতে শুরু করে কাউনের আবাদ। ফলে কাউন এখন গরিবের নয়, ধনীদের বিলাসী ও শৌখিন খাবারে পরিণত হয়েছে।

তবে কাউনের চাল অত্যন্ত পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ খাবার। এতে প্রচুর পরিমাণে আমিষ ও খনিজ লবণ আছে। এ ছাড়া এই চালে ভিটামিন বি, প্রোটিন, ফাইবার ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট আছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত বছর (২০২২) পঞ্চগড় জেলায় ১৫ হেক্টর জমিতে কাউনের আবাদ হয়েছিল। তবে এ বছর (২০২৩) তা কমে গিয়ে আবাদ হয়েছে মাত্র ৩ হেক্টর জমিতে।

আরশেদ আলী বলেন, বৃহস্পতিবার সকালে ২৩ কেজি কাউনের চাল নিয়ে বাজারে আসেন। রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত প্রায় ১৮ কেজি চাল বিক্রি করেন। দাম একটু বেশি হওয়ায় দাম শুনেই অনেকেই চলে যান। চাল বিক্রির জন্য তাঁর কোনো স্থায়ী জায়গা নেই। মানুষের দোকানের সামনে একটু জায়গা নিয়ে বসেছেন। এ জন্য তাঁকে খাজনাও গুনতে হয়। কেউ অসুবিধা মনে করলে চালের গামলা নিয়ে আবার অন্য জায়গায় সরে যান।

কাউনের চাল মেপে বিক্রি করছেন আরশেদ আলী। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে পঞ্চগড় বাজার জামে মসজিদ মার্কেটসংলগ্ন একটি ফলের দোকানের সামনে

আরশেদ আলীর ছোট ছেলে মাছের দোকানে কাজ করে কিছু টাকা আয় করেন। বাবা-ছেলে মিলে বর্গা নিয়ে দুই বিঘা জমিতে চাষাবাদ করেছেন। দুটি এনজিও থেকে কিছু টাকা ঋণ নিয়ে বাছুরসহ দুটি গরু কিনেছেন। আর কিছু টাকা ব্যবসার কাজে লাগিয়েছেন। প্রতিদিন খরচ বাদ দিয়ে গড়ে অন্তত ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা আয় হয় তাঁর। তা দিয়ে সংসার খরচের পাশাপাশি ঋণের কিস্তি দিতে হয়। এসব দিয়ে সংসার চলছিল। কিন্তু বর্তমানে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁকে।

আরশেদ আলীর সঙ্গে আলাপকালে কাউনের চাল কিনতে আসেন আবদুল মান্নান (৫৮) নামের স্থানীয় এক মাদ্রাসাশিক্ষক। আধা কেজি চাল কিনে তিনি বলেন, একসময় এসব চাল গরিবের খাবার ছিল। আর এখন পাওয়াই যায় না। কাউনের চালের ভাত নাতি-নাতনিদের খাওয়ানোর জন্য এবং এর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি এই চাল কিনেছেন।