চিরিরবন্দরে গড়ে ওঠা ২৭টি আবাসিক বিদ্যালয়ে পড়তে আসছে বিভিন্ন জেলার শিক্ষার্থীরা। পরিচিতি পাচ্ছে শিক্ষানগরী হিসেবে।
দুই যুগ আগেও দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলায় একটি সরকারি উচ্চবিদ্যালয় ছাড়া ভালো মানের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না। সেই চিরিরবন্দরে এখন পড়ালেখা করতে আসছে দেশের বিভিন্ন জেলার শিক্ষার্থীরা। এখানকার আবাসিক স্কুল-কলেজের পাট চুকিয়ে তারা জায়গা করে নিচ্ছে দেশের নামকরা সব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।
শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা বলছেন, গত দুই দশকে একের পর এক ভালো মানের ‘বোর্ডিং স্কুল’ বা আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার পাশাপাশি শিক্ষানুরাগী ও শিক্ষকদের অবিরাম প্রচেষ্টার কারণে বদলে গেছে উপজেলার শিক্ষাব্যবস্থার চিত্র। কার্যকর ও সময়োপযোগী শিখন পদ্ধতি, শিক্ষকদের আন্তরিকতা, নিয়মশৃঙ্খলা ও পড়াশোনার সুন্দর পরিবেশের কারণে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় ধারাবাহিকভাবে ভালো ফল করছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে শুধু দিনাজপুরই নয়, রংপুর-রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকেও অনেক শিক্ষার্থী এ উপজেলায় পড়াশোনার জন্য আসছে। এ কারণে চিরিরবন্দর ‘শিক্ষানগরী’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ফজলে এলাহী বলেন, গত দুই দশকে এ উপজেলায় শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক এগিয়েছে। পাঠদানের পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রমে গুরুত্ব দেওয়ায় এখানকার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ভালো করছে।
এগিয়ে যাওয়ার পেছনের গল্প
২০ বছর আগে চিরিরবন্দরে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ১২০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল। বর্তমানে এই সংখ্যা ১৯৭। যার ৭৩টি বেসরকারি। এর মধ্যে ২৭টিতে আবাসিক সুবিধা আছে। শিক্ষানুরাগী আমজাদ হোসেনের হাত ধরে শিক্ষাক্ষেত্রে এই পরিবর্তন এসেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। পেশায় চিকিৎসক আমজাদ হোসেন ২০০০ সালে উপজেলার ঘুঘরাতলীতে ৫০ শতক জমিতে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। মা-বাবার নামে নাম দেন আমেনা-বাকী রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল ও কলেজ। প্রায় শুরু থেকে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে ছিলেন মিজানুর রহমান।
মিজানুর রহমান বলেন, ‘ঘুঘরাতলী এলাকাটা ছিল ভুতুড়ে। সন্ধ্যার পর এদিকে কেউ আসত না। আমজাদ স্যার সেখানেই শুরু করলেন স্কুল। মাইকিং করে শিক্ষার্থী আনতে হয়েছিল। নার্সারি থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ১৩৪ জন শিক্ষার্থী ও ১২ জন শিক্ষক নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়। তারপর ধীরে ধীরে নিম্নমাধ্যমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক শাখা চালু হয়।’
বর্তমানে প্রায় ১০ একর জমিতে আটটি ভবনে (আবাসিক ও একাডেমিক) কার্যক্রম চলছে আমেনা-বাকী রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল ও কলেজের। এখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার। শিক্ষক রয়েছেন শতাধিক। শুরু থেকে শতভাগ পাসের রেকর্ডও গড়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
আমেনা-বাকীর পর ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠা পায় আইডিয়াল রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল। এক যুগের ব্যবধানে সেই প্রতিষ্ঠানটিও বড় হয়েছে। চার একর জমিতে এখন সাতটি সুউচ্চ ভবন হয়েছে। সেখানেও শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ হাজার এবং শিক্ষক ৫৫।
শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঘুঘরাতলী এলাকায় বর্তমানে বেসরকারি ২২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ভালো করছে। এর মধ্যে অধিকাংশ বিদ্যালয়ই আবাসিক। প্রায় ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বিভিন্ন জেলা থেকে এসেছে।
আইডিয়াল রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী মায়িশা আক্তার। বাড়ি নওগাঁর পত্নীতলায়। মায়িশার ভাই জিহান মোর্শেদও একই বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে পড়ছে। মায়িশা জানায়, বাবা কলেজের শিক্ষক, মা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। দুজনেই সকালে বাসা থেকে বের হয়ে যান। তাই তাঁদের আবাসিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়েছেন।
রুটিন মেনে পড়াশোনা ও সহশিক্ষা
উপজেলার কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘুরে জানা যায়, এসব প্রতিষ্ঠানে সর্বনিম্ন দেড় শ থেকে আড়াই হাজার পর্যন্ত শিক্ষার্থী রয়েছে। তাদের মধ্যে আবাসিকে থাকছে এক-তৃতীয়াংশ। কঠোর নিয়মশৃঙ্খলার মধ্যে রাখা হয়েছে শিক্ষার্থীদের। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের রয়েছে নিজস্ব খেলার মাঠ, গ্রন্থাগার, মসজিদ, কম্পিউটার ল্যাবরেটরিসহ নানা সুযোগ-সুবিধা।
আমেনা-বাকী রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল ও কলেজের শিক্ষক জয়ন্ত কুমার রায় জানান, শিক্ষার্থীরা ভোর সাড়ে পাঁচটায় ঘুম থেকে ওঠে। এরপর সকালের নাশতা সেরে চলে যায় পড়ার কক্ষে। দুই ঘণ্টা পড়াশোনা শেষে ১০টায় অ্যাসেম্বলিতে (সমাবেশ) যোগ দিতে হয়। সাড়ে ১০টায় পাঠদান শুরু হয়ে চলে ৪টা পর্যন্ত। মাঝখানে এক ঘণ্টার মধ্যাহ্নবিরতি থাকে। বিকেলে চলে সহশিক্ষা কার্যক্রম, খেলাধুলা, আড্ডা। সন্ধ্যা সাতটায় রাতের খাবার শেষে পড়ার কক্ষে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের কাছে কোচিং ক্লাস চলে রাত ১০টা পর্যন্ত। ১০টার পর হালকা নাশতা করে ঘুমাতে যায় শিক্ষার্থীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব প্রতিষ্ঠানে নার্সারি থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত প্রত্যেক শিক্ষার্থীর আবাসিক খরচ ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা পড়ে। আর টিউশন ফি শ্রেণিভেদে ৫০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত।
দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার বাসিন্দা আব্দুর রহিম চার ছেলেমেয়ের সবাইকে আবাসিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করেছিলেন। বড় দুই মেয়ে এখন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। ছেলেদের মধ্যে একজন উচ্চমাধ্যমিকে, অপরজন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। আবদুর রহিম বলেন, ‘এলাকার পরিবেশ ভালো না। ভালো শিক্ষকও নেই। বাড়িতে থাকলে মুঠোফোন চালাবে, পড়ালেখা না করে ঘুরে বেড়াবে, ভালো মানুষ হবে না, এসব চিন্তা করে সন্তানদের আবাসিক স্কুলে দিয়েছি।’
সাফল্যের দেখা পাচ্ছে শিক্ষার্থীরা
চিরিরবন্দরে পড়তে আসা অনেক শিক্ষার্থী প্রতিবছর দেশের খ্যাতনামা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে শুধু আমেনা-বাকী রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল ও কলেজ এবং আইডিয়াল রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলের ১৪ জন শিক্ষার্থী বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে, ৪ জন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট), ৭৮ জন বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ১১ জন অন্যান্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন।
উপজেলার রানীবন্দর এলাকার সানলাইট স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন মাহমুদ হাসনাত। তিনি এবার বুয়েটের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে সুযোগ পেয়েছেন। মুঠোফোনে তিনি বলেন, ‘একই বই, একই সিলেবাসের পরও প্রাইভেট স্কুলগুলো ভালো করছে। এটার বড় কারণ হচ্ছে মনিটরিং সিস্টেম। বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চেয়ে পরিচালনা পর্ষদ অনেক সচেতন। একজন শিক্ষার্থীর জন্য যত সুন্দর পরিবেশ করা যায়, তার প্রায় পুরোটাই স্কুলে পেয়েছি। নিয়মশৃঙ্খলার মধ্যে চলতে হয়েছে। যেটা এখনো ধরে রেখেছি। শিক্ষকদের সহযোগিতা অনেক বেশি পেয়েছি। বিদ্যালয়ে সহশিক্ষা কার্যক্রমেও অনেক গুরুত্ব দেওয়া হতো।’
আমেনা-বাকী রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল ও কলেজের প্রতিষ্ঠাতা আমজাদ হোসেন বলেন, ‘এলাকায় যুগোপযোগী শিক্ষার প্রসারে নার্সারি থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত দিয়ে কার্যক্রম শুরু করেছিলাম। যে উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু করেছিলাম, সেটা অনেকাংশেই সফল হয়েছে। এখান থেকে পড়াশোনা করে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রতিনিধিত্ব করছে আমার ছাত্ররা। এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে।’
সবার মধ্যে ভালো করার প্রতিযোগিতা
আমেনা-বাকী রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থী মুইন হাসনাত এবার রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছেন। তিনি বলেন, ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে বিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হয়। ভালো শিক্ষার্থীরাই এখানে ভর্তির সুযোগ পায়। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পড়ালেখায় ভালো করার একধরনের প্রতিযোগিতা চলে।
শুধু শিক্ষার্থীই নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেও ভালো করার প্রতিযোগিতা চলে বলে জানালেন আইডিয়াল রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল ও কলেজের পরিচালক মোমিনুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে চিরিরবন্দর শিক্ষানগরীর কথা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ায় অভিভাবকদের একটা আস্থার জায়গা তৈরি হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে গুণগত মান ও পরিবেশ উন্নত করার একটা প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে।