বিকেল পৌনে চারটা। ভোট গ্রহণ শেষ হতে বাকি মাত্র ১৫ মিনিট বাকি। বগুড়ার গাবতলী উপজেলার চকবোচাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের বাইরে অর্ধশত যুবকের জটলা। ভেতরে ভোটার নেই, সুনসান পরিবেশ। কেন্দ্রটির নারী ভোটারদের একটি কক্ষে ছয়-সাতজন পুরুষের ভিড়। দুই-তিনজনের বুকে নৌকার ব্যাজ লাগানো। কক্ষে নারী ভোটার নেই। নাম-ঠিকানা যাচাই ছাড়াই ভোট কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ব্যালট নিয়ে প্রকাশ্যে নৌকা প্রতীকে সিল মারছেন ওই যুবকেরা। তাঁদের মধ্যে ১৩-১৪ বছর বয়সী এক কিশোরকেও ভোট দিতে দেখা গেল।
বিকেলে চকবোচাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে ৯টি কক্ষে ভোট গ্রহণ করতে দেখা যায়। এর মধ্যে ১ ও ৩ নম্বর বুথের ব্যালট ফুরিয়ে যাওয়ায় ভোট গ্রহণ বন্ধ ছিল। ওই কক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা বলেন, বেলা সাড়ে তিনটার দিকে ব্যালট ফুরিয়ে যায়। প্রিসাইডিং কর্মকর্তার নির্দেশে কক্ষের ভোট গ্রহণ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ওই কক্ষের কেউ ভোট দিতে এলে পাশের কক্ষে পাঠানো হচ্ছে।
৪ নম্বর বুথে সাত-আটজন ভোটার একসঙ্গে ভোট দিতে ঢুকেছেন। ভোট গ্রহণের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা নাম-ঠিকানা জিজ্ঞাসা না করেই তাঁদের হাতে ব্যালট ধরিয়ে দিয়েছেন। ব্যালট হাতে পেয়ে কর্মকর্তাদের সামনেই প্রকাশ্যে নৌকায় সিল মারছেন কয়েকজন। বেলা ৩টা ৫০ মিনিটে রফিকুল ইসলাম নামের এক ভোটারের স্লিপ নিয়ে ভোট দিতে আসে এক কিশোর। সাংবাদিকেরা নজরে আনলে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা তাঁকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেন।
৭ ও ৮ নম্বর কক্ষে একসঙ্গে সাত-আটজন যুবককে ভোট দিতে ঢুকতে দেখা গেল। যাচাই-বাছাই ছাড়াই তাঁদের হাতে ব্যালট ধরিয়ে দেন ভোট গ্রহণের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। গোপন বুথে একসঙ্গে তিনজনকে ঢুকতে যান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুজন ভোটার অভিযোগ করে বলেন, ‘দুপুরের আগেই নৌকার কর্মীরা এই কেন্দ্র দখলে নেন। এরপর বেশ কয়েকটি ব্যালটের মুড়ি নিয়ে বাইরে গিয়ে সিল মেরে বাক্সে এনে ফেলেছেন। এ জন্য কোনো কোনো বুথে ব্যালট নেই। এ ছাড়া নৌকার কর্মীরা গণহারে জাল ভোট দিয়েছেন।’
ভোট গ্রহণ শেষে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কেন্দ্রের ৩ হাজার ৮৫০ ভোটারের মধ্যে ১ হাজার ৪০২ ভোট পড়েছে। ভোট পড়ার হার ৩৬ দশমিক ৪১। সকাল আটটা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত ৬ ঘণ্টায় ৭৯৭টি ভোট পড়ে। শেষ দুই ঘণ্টায় ভোট পড়েছে ৬০৫টি। শেষ দুই ঘণ্টায় ভোট পড়ার হার ১৫ দশমিক ৭১। জাল ভোটের বিষয়ে তিনি দাবি করেন, ‘ভোটে কোনো অনিয়ম হয়নি। কোনো জাল ভোটও পড়েনি।’
দিন শেষে চকবোচাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ৩৬ শতাংশ ভোট পড়লেও কয়েক কিলোমিটার দূরে একই আসনের বাইগুনী সরকারি বিদ্যালয়ের পুরুষ ও নারীর দুটি কেন্দ্রে যথাক্রমে ১৪ ও ১১ শতাংশের কিছু বেশি ভোট পড়েছে। বেলা সোয়া তিনটার দিকে বাইগুনী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পুরুষ ও নারী কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, একজনও ভোটার নেই। ফাঁকা কেন্দ্রে অলস বসে আছেন ভোট গ্রহণ কর্মকর্তারা।
পুরুষ কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, তাঁর কেন্দ্রে মোট ভোটার ২ হাজার ৬২৯। পাঁচটি বুথে বিকেল চারটা পর্যন্ত ভোট পড়েছে ৩৭৩টি। ভোট পড়ার হার ১৪ দশমিক ১৮। নারী কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা আবদুল আহাদ বলেন, এখানকার মোট ভোটার ২ হাজার ৬৬৪। চারটা পর্যন্ত ভোট পড়েছে ৩১৮টি। ভোট পড়ার হার ১১ দশমিক ৯৩।
বগুড়ার রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বগুড়ার সাতটি আসনে অত্যন্ত সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে ভোট গ্রহণ শেষ হয়েছে। জেলায় গড়ে ২৭ শতাংশ ভোট পড়েছে।
বগুড়া-৭ (গাবতলী-শাজাহানপুর) আসনে নৌকা প্রতীকে মোস্তফা আলম, লাঙ্গল প্রতীকে এ টি এম আমিনুল ইসলাম, মশাল প্রতীকে আবদুর রাজ্জাক, ডাব প্রতীকে বাংলাদেশ কংগ্রেসের মেহেরুল আলম, বাইসাইকেল প্রতীকে আবদুল মজিদ, কলার ছড়ি প্রতীকে বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তি জোটের এনামুল হক, আম প্রতীকে এনপিপির ফজলুল হক, নোঙর প্রতীকে বিএনএমের মো. রনি ছাড়াও ঈগল প্রতীকে সরকার বাদল ও ট্রাক প্রতীকে রেজাউল করিম স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
ভোটের ফলাফলে রাগেবুল আহসান বেসরকারিভাবে বিজয়ী হয়েছেন। ১১৪টি কেন্দ্রের ঘোষিত পূর্ণাঙ্গ ফলাফলে রাগেবুল আহসান নৌকা প্রতীকে পেয়েছেন ৫৩ হাজার ২২৬ ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বগুড়া শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল মান্নান ট্রাক প্রতীকে পেয়েছেন ২২ হাজার ৮৪০ ভোট।