এক সপ্তাহ আগেও বরিশাল নগরের অলিগলি, সড়কে শোভা পেত মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর ছবিসংবলিত বিশাল বিশাল ব্যানার-ফেস্টুন। অন্য কোনো নেতার ব্যানার সাঁটানো যেন অঘোষিতভাবেই নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দৃশ্যপট আকস্মিক পাল্টে যায়। নগরের বিভিন্ন মোড়ে, সড়কে, অলিগলিতে সাদিক আবদুল্লাহর সেসব বড় ব্যানার-ফেস্টুনের পাশে জায়গা নিতে শুরু করে তাঁর চাচা আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাতের ছবিসংবলিত বড় বড় ব্যানার-ফেস্টুন।
শুধু ব্যানার-ফেস্টুনই নয়, নগরের সদর রোড, হাসপাতাল রোড, বিএম কলেজ এলাকা, নথুল্লাবাদসহ বিভিন্ন স্থানে আবুল খায়ের আবদুল্লাহর পক্ষে তাঁর কর্মী-সমর্থকেরা তোরণ নির্মাণ করেছেন। পাশাপাশি কিছু কিছু এলাকায় বরিশাল সদর আসনের সংসদ সদস্য ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের ছবিসংবলিত ব্যানার-ফেস্টুনও দেখা যাচ্ছে। অথচ এক সপ্তাহ আগেও এই নগরে এটা ছিল কল্পনার বাইরে।
এর আগে প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের সামান্য কিছু ফেস্টুন শোভা পেত সিঅ্যান্ডবি রোডের সদর উপজেলা পরিষদ চত্বর, আমতলা মোড়সহ শহরের দূরবর্তী এলাকায়। কিন্তু মূল শহরে তাঁর কোনো ব্যানার-ফেস্টুন দেখা যায়নি কখনো। এমনকি অন্য কোনো নেতারও নয়।
নগরে পাঁচ বছর ধরে সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর প্রচার-প্রচারণায় এমন একক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভেতরে-ভেতরে ক্ষোভ-সমালোচনা ছিল দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে। তবে কেউই এ নিয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে পারেননি। নাগরিকদের মধ্যে ছিল নেতিবাচক আলোচনা-অস্বস্তি।
২০২১ সালের ১৮ আগস্ট রাতে বরিশাল সদর উপজেলা পরিষদের ভেতরে ইউএনওর বাড়িতে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের যে হামলার ঘটনা ঘটেছিল, এর মূলেও ছিল প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের পক্ষে লাগানো বিভিন্ন শুভেচ্ছা ব্যানার-ফেস্টুন খুলে ফেলার ঘটনা। ওই দিন রাতে উপজেলার পরিষদ চত্বরে জাহিদ ফারুকের পক্ষে লাগানো ব্যানার-ফেস্টুন অপসারণে গিয়েছিল সিটি করপোরেশনের একদল কর্মচারী। সঙ্গে ছিলেন ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মী। কিন্তু রাতে ব্যানার অপসারণে বাধা দেন ইউএনওর বাড়িতে কর্তব্যরত আনসার সদস্যরা। বাগ্বিতণ্ডা শুনে সেখানে হাজির হন তৎকালীন ইউএনও মুনিবুর রহমান। তিনিও রাতে এসব ব্যানার অপসারণে বাধা দেন। এ নিয়ে ইউএনর বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে। পরে সেখানে আনসার সদস্যরা ফাঁকা গুলি বর্ষণ করেছিলেন। ওই সময় ঘটনাটি দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচিত হয়েছিল।
গত পাঁচ বছর এই শহরে কোনো রাজনৈতিক নেতা নিজেদের প্রচারে একটি শুভেচ্ছা ব্যানারও লাগাতে পারেননি—এটা সত্য। কিন্তু আওয়ামী লীগ এমন রাজনৈতিক সংস্কৃতির দল নয়। বরিশালে এমন সংস্কৃতি তৈরি করা হয়েছিল। এর পরিণতি যে ভালো হয় না, সেটা এবারের মনোনয়ন থেকেই বোঝা গেল।মীর আমিন উদ্দীন, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বরিশাল নগর আওয়ামী লীগ
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) বরিশাল নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক রফিকুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রচার-প্রচারণায় সব রাজনৈতিক দলের সমান অধিকার সুনিশ্চিত করার সংস্কৃতি চালু থাকলে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত হয়। বরিশালে অতীতে আমরা দেখেছি, প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেনের হিরণের সময়ে বিরোধী দলের সমাবেশ সফল করতে তিনি সহায়তা করতেন। সবাই শহরে সমান প্রচার চালাতে পারতেন। কিন্তু গত পাঁচ বছর সেটা অনুপস্থিত ছিল। এবার নতুন যে নেতৃত্ব আসবেন, তাঁদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা, সবার জন্য যেন সমান সুবিধা নিশ্চিত করা হয়। পাশাপাশি ব্যানার-ফেস্টুনের প্রচারের সংস্কৃতি থেকেও বের হয়ে আসা দরকার।’
গতকাল নগরের আলেকান্দা, বাংলাবাজার, বটতলা, এম এ জলিল সড়ক, সদর রোড, নথুল্লাবাদ, হাসপাতাল রোড, আমতলা মোড়, কাশিপুর এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এসব স্থানে সড়কের পাশে বড় বড় ব্যানার শোভা পাচ্ছে। এতে আবুল খায়ের আবদুল্লাহর ছবি রয়েছে। রয়েছে অনেক তোরণ।
গতকাল বিশাল শোভাযাত্রা করে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ–মনোনীত মেয়র প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহকে বরিশালে বরণ করে নিয়েছেন, তাঁর সমর্থক নেতা-কর্মীরা। ঢাকা থেকে গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায় বরিশালে পৌঁছালে নগরের গড়িয়ারপাড়, কাশিপুর, নথুল্লাবাদ, বিএম কলেজ এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে সমর্থকেরা আবুল খায়ের আবদুল্লাহকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান। বেলা দেড়টায় তিনি সদর রোডে দলীয় কার্যালয়ের সামনের সংবর্ধনাস্থলে এসে পৌঁছান। নগরে প্রবেশের পরপর বিশাল গাড়িবহর ফুলের পাপড়িতে ছেয়ে যায়। ছাদখোলা গাড়িতে দাঁড়িয়ে আবুল খায়ের আবদুল্লাহ সড়কের পাশে অপেক্ষমাণ নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানান। প্রচণ্ড গরম ও রোদের মধ্যে সড়কের দুই পাশ অসংখ্য সমর্থকের মুহুর্মুহু স্লোগানে মুখর ছিল।
আবুল খায়ের আবদুল্লাহর সঙ্গে বরিশালে আসেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল হোসেন, বরিশাল সদর আসনের সংসদ সদস্য ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক। সদর রোডে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনুস। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন নগর আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আফজালুল করিম। এতে সভাপতিত্ব করেন নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম জাহাঙ্গীর হোসাইন।
জেলা ও নগর আওয়ামী লীগের এই তিন নেতা ছাড়া সেখানে নগর ও জেলা আওয়ামী লীগের অন্য কোনো নেতাকে দেখা যায়নি। বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দলটির বর্ষীয়ান নেতা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এবং নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাঁর ছেলে বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ দুজনই ঢাকায় অবস্থান করছেন।
নগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মীর আমিন উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, গত পাঁচ বছর এই শহরে কোনো রাজনৈতিক নেতা নিজেদের প্রচারে একটি শুভেচ্ছা ব্যানারও লাগাতে পারেননি—এটা সত্য। কিন্তু আওয়ামী লীগ এমন রাজনৈতিক সংস্কৃতির দল নয়। বরিশালে এমন সংস্কৃতি তৈরি করা হয়েছিল। এর পরিণতি যে ভালো হয় না, সেটা এবারের মনোনয়ন থেকেই বোঝা গেল।
মীর আমিন উদ্দীন আরও বলেন, শুধু এটাই নয়, বরিশালে ত্যাগী প্রকৃত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের অনেকেরই এখন আর দলে পদ-পদবি নেই। তাঁরা ছিটকে পড়েছেন এমন সংস্কৃতির কারণে। অথচ নির্বাচনী মাঠে তাঁরাই দলের পক্ষে সবচেয়ে বড় শক্তি। এই অপসংস্কৃতির বন্ধ করার সেই পদবঞ্চিত, নিগৃহীত বিশাল অংশটি এবার ঐক্যবদ্ধভাবে আবুল খায়ের আবদুল্লাহর পক্ষে মাঠে নেমেছেন।
১৫ এপ্রিল দেশের পাঁচ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী চূড়ান্ত করে আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ড। এতে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান আবুল খায়ের আবদুল্লাহ। মনোনয়ন পাওয়ার পর তিনি এই প্রথম বরিশালে ফিরলেন।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বোন আমেনা বেগমের ছোট ছেলে আবুল খায়ের আবদুল্লাহ। তিনি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ছোট ভাই এবং বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর চাচা। সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহকে মেয়র পদে মনোনয়ন দিতে মহানগর ও জেলা আওয়ামী লীগ একক প্রার্থী হিসেবে প্রস্তাব পাঠালেও তা অগ্রাহ্য হয়। এ কারণে সাদিক আবদুল্লাহর সমর্থকেরা হতাশ হন।