রোববার বেলা সাড়ে ১১টা। নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা পরিষদে চলছে আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভা। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইকবাল হাসানের সভাপতিত্বে সভায় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা অংশ নিলেও অনুপস্থিত উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান লায়লা কানিজ। পরিষদে তাঁর কক্ষটিও তালাবদ্ধ।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছাগল-কাণ্ডে আলোচিত রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমানের প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ। ছাগল–কাণ্ডের পর থেকেই উপজেলা চেয়ারম্যান লায়লা কানিজকে জনসমক্ষে দেখা যাচ্ছে না। তিনি কার্যালয়ে আসছেন না, বাড়িতেও নেই। মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যাচ্ছে না।
উপজেলা পরিষদের কর্মকর্তারা বলছেন, ঈদের দুই দিন আগে সর্বশেষ অফিস করেছেন লায়লা কানিজ। ঈদের ছুটি শেষে এ পর্যন্ত একবারের জন্যও কার্যালয়ে আসেননি তিনি। তাঁদের ধারণা, তিনি ছাগল–কাণ্ডে বেশ বিব্রত। সাংবাদিকেরাও বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর পেতে তাঁর কার্যালয়ে এসে খোঁজাখুজি করছেন।
রায়পুরার ইউএনও ইকবাল হাসান বলেন, ঈদের পর উপজেলা চেয়ারম্যান লায়লা কানিজ তাঁর কার্যালয়ে আসেননি। আজ রোববার সকালে অনুষ্ঠিত উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভাতেও তিনি অংশ নেননি। ব্যক্তিগত কারণে তিনি আজ আসতে পারবেন না জানিয়ে ছিলেন। কিন্তু কবে আসবেন তা বলেননি, কোনো ছুটিও নেননি।
সরকারি তিতুমীর কলেজের বাংলা বিষয়ের সহযোগী অধ্যাপকের চাকরি ছেড়ে ২০২২ সালে রাজনীতিতে এসেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উপজেলা চেয়ারম্যান হন লায়লা কানিজ। আছেন জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্বে। ছাগল–কাণ্ডের পর তাঁর নামে থাকা সম্পদের বিবরণ শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন স্থানীয় ব্যক্তিরা।
স্থানীয় ব্যক্তিরা বলছেন, লায়লা কানিজ সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করলেও রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমানের সঙ্গে বিয়ের পর ভাগ্য খুলে যায়। গত ১৫ বছরে তাঁর সম্পদ লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। সংসদ সদস্য রাজিউদ্দীন আহমেদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে তাঁর উত্থান দেখেছেন স্থানীয় ব্যক্তিরা। মরজাল এলাকায় পৈতৃক বাড়িতে একটি ডুপ্লেক্স ভবন নির্মাণ করেছেন তিনি। ছোট একটি পার্ককে ক্রমে ক্রমে আধুনিক করে ইকো রিসোর্ট তৈরি করেছেন। এলাকায় প্রচুর দান-খয়রাতও করেন। উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকে তিনি রায়পুরার রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ একজন হয়ে উঠেছেন।
আজ রোববার দুপুরে মরজাল বাসস্ট্যান্ড থেকে এক কিলোমিটার দূরত্বের মতিউর রহমান ও লায়লা কানিজ দম্পতির ডুপ্লেক্স বাড়িতে গেলে ভেতরে ঢুকতে দেননি কেয়ারটেকার। তিনি জানান, উপজেলা চেয়ারম্যান বাড়িতে নেই। ফটকের বাইরে থেকে দেখা যায়, আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর বাড়িটি বেশ বিলাসবহুল। বাড়িজুড়ে দেশি-বিদেশি গাছের সারি, সবুজ ঘাসের আঙিনা। পেছনে রয়েছে শানবাঁধানো ঘাট ও লেক। পাশে রয়েছে কর্মচারীদের থাকার স্থান। এটিও নান্দনিক একটি স্থাপনা।
বাড়ির ভেতরে গেছেন এমন কয়েকজন বলেন, বাড়িতে মতিউর রহমান কখনো কখনো এলেও প্রায় সব সময়ই লায়লা কানিজ থাকেন। এর ভেতরে রাজকীয় সব আসবাবপত্র ও দামি জিনিসপত্রে ঠাসা।
মরজালে নিজ এলাকায় প্রায় দেড় একর জমিতে ‘ওয়ান্ডার পার্ক ও ইকো রিসোর্ট’ নামের একটি বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তুলেছেন লায়লা কানিজ। যদিও পার্কটির মালিকানা তাঁর দুই সন্তান তৌফিকুর রহমান (অর্ণব) ও ফারজানা রহমানের (ইপ্সিতা) নামে। ভেতরের প্রায় তিন বিঘা আয়তনের লেকটি লায়লা কানিজের ‘লাকি মৎস্য খামার’ নামে নিবন্ধিত।
ওয়ান্ডার পার্ক ও ইকো রিসোর্টে গিয়ে দেখা গেছে, ভেতরে বিলাসবহুল একাধিক কটেজ। বিভিন্ন বয়সীদের জন্য রয়েছে বেশ কিছু রাইড। পার্কজুড়ে বিভিন্ন ভাস্কর্য ও স্থাপনা। প্রতিদিন শত শত মানুষ এই পার্কে ঘুরতে আসেন। এটি স্থানীয় ব্যক্তিদের কাছে উপজেলা চেয়ারম্যান ‘লায়লা কানিজ লাকির পার্ক’ বলে পরিচিত।
পার্কটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক পরিচয় দেওয়া আবুল খায়ের মানিক নামের একজন বলেন, লায়লা কানিজ পার্কের ভেতরের শুধু পুকুরের মালিক। তবে পরিচালক হিসেবে রয়েছেন মতিউর-লায়লা দম্পতির দুই সন্তান।
উপজেলা আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, পার্কটিতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল সংসদ সদস্য রাজিউদ্দীন আহমেদের। একপর্যায়ে লায়লা কানিজকে রাজনীতিতে আমন্ত্রণ জানান তিনি। ২০২২ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান সাদেকুর রহমান ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে উপনির্বাচনে প্রার্থী হন এবং সংসদ সদস্যের প্রভাবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান হন তিনি। অবস্থা এখন এমন, সংসদ সদস্য ও উপজেলা চেয়ারম্যান একটি পক্ষ আর সব আওয়ামী লীগ নেতা আরেক পক্ষ। সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত একজন শিক্ষক হয়ে কীভাবে তিনি এত সম্পদের মালিক হলেন, সেই প্রশ্নে সবাই বিস্মিত।
রায়পুরা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আফজাল হোসাইন বলেন, ‘দুঃখের কথা কী আর বলব? এমপি সাহেবের উৎসাহেই রাজনীতিতে এসেছেন লায়লা কানিজ। তিনি একটা টাকার পাহাড়। স্বামীর অবৈধ টাকার প্রভাবেই এমপি সাহেব তাঁকে উপজেলা চেয়ারম্যান বানিয়েছেন। তাঁকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের খুব বড় ক্ষতি করে ফেলেছেন সংসদ সদস্য রাজিউদ্দীন আহমেদ।’
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে সংসদ সদস্য রাজিউদ্দীন আহমেদের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি ধরেননি। পরে এসএমএস পাঠিয়ে ও হোয়াটসঅ্যাপে কল দিয়েও তাঁর সাড়া পাওয়া যায়নি।
লায়লা কানিজ সদ্য শেষ হওয়া ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়েছিলেন। কিন্তু ভোট গ্রহণের আগে এক ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী নিহত হলে নির্বাচন স্থগিত করে নির্বাচন কমিশন। ওই নির্বাচনের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় দেখা গেছে, লায়লা কানিজের সম্পদের মধ্যে ১৫৪ শতাংশ কৃষিজমি ছাড়াও রয়েছে রাজউকে ৫ কাঠা, সাভারে সাড়ে ৮ কাঠা, গাজীপুরে ৫ কাঠা, গাজীপুরের পুবাইলে ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ ও ২ দশমিক ৯০ শতাংশ, গাজীপুরের খিলগাঁওয়ে ৫ শতাংশ ও ৩৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ, গাজীপুরের বাহাদুরপুরে ২৭ শতাংশ, গাজীপুরের মেঘদুবীতে ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ, গাজীপুরের ধোপাপাড়ায় ১৭ শতাংশ, রায়পুরায় ৩৫ শতাংশ, ৩৫ শতাংশ ও ৩৩ শতাংশ, রায়পুরার মরজালে ১৩৩ শতাংশ, সোয়া ৫ শতাংশ, ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ, ২৬ দশমিক ২৫ শতাংশ ও ৪৫ শতাংশ, শিবপুরে ২৭ শতাংশ ও ১৬ দশমিক ১৮ শতাংশ, শিবপুরের যোশরে সাড়ে ৪৪ শতাংশ, নাটোরের সিংড়ায় ১ একর ৬৬ শতাংশ জমি।
নির্বাচনী হলফনামা বলছে, লায়লা কানিজের বার্ষিক আয় কৃষি খাত থেকে ১৮ লাখ, বাড়ি-অ্যাপার্টমেন্ট-দোকান ও অন্যান্য ভাড়া থেকে ৯ লাখ ৯০ হাজার, শেয়ার-সঞ্চয়পত্র-ব্যাংক আমানতের লভ্যাংশ থেকে ৩ লাখ ৮২ হাজার ৫০০ টাকা, উপজেলা চেয়ারম্যানের সম্মানী বাবদ ১ লাখ ৬৩ হাজার ৮৭৫, ব্যাংক সুদ থেকে ১ লাখ ১৮ হাজার ৯৩৯ টাকা। বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তাঁর জমা রয়েছে ৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।
স্থানীয় ব্যক্তিরা বলছেন, তিনি এসব সম্পদ গড়েছেন তাঁর স্বামী আলোচিত রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমানের অবৈধ উপার্জনে। শিক্ষকতার আয়ে বা পেনশনের টাকায় তাঁর এত সম্পদ থাকার কথা নয়।
এসব বিষয়ে লায়লা কানিজের ব্যবহৃত তিনটি মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে বন্ধ পাওয়া যায়। তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) নাজমুল হোসেন মুঠোফোনে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘লায়লা কানিজ ম্যাডাম রায়পুরায় নেই, তিনি ঢাকায় আছেন।’ এ বিষয়ে আর কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।