দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননকেন্দ্র হালদা নদীতে টানা ১২ দিন একের পর এক বড় মা মাছ ও ডলফিন মরে ভেসে ওঠার ঘটনা ঘটছে। গতকাল সোমবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে নদীর রাউজান অংশের পশ্চিম গুজরা ইউনিয়নের আজিমের ঘাটে আরও একটি বড় ডলফিন ও মা মাছ মরে ভেসে ওঠে।
নদীর স্বেচ্ছাসেবক ও ডিম সংগ্রহকারী আজিমের ঘাটের বাসিন্দা রোশাঙ্গীর আলম জানিয়েছেন, সোমবার রাতে ভেসে আসা ডলফিনটিও বড় আকারের ছিল। আর মা মাছটি আকারে তুলনামূলক ছোট। ডলফিনটির ওজন ৭০ থেকে ৮০ কেজি এবং মা মাছটি ৭ থেকে ৮ কেজি ওজনের হবে বলে ধারণা তাঁর।
তবে জোয়ারের তীব্রতা আর ভারী বৃষ্টিতে ডলফিন আর মা মাছ উদ্ধার করতে পারেননি তিনি। তিনি বলেন, আজিমের ঘাটের পাশেই তাঁর নিজস্ব হ্যাচারি রয়েছে। নদীর পারে জোয়ারের সময় রাত সাড়ে ১১টায় টহল দিতে গেলে প্রতিরক্ষা বাঁধের ব্লক পাথরে আটকে থাকতে দেখেন একটি ডলফিন ও একটি মা মাছ। তখন তিনি ছবি তুলে রাউজান উপজেলা মৎস্য সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আব্দুল আল মামুন এবং হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান মনজুরুল কিবরিয়াকে পাঠান এবং ঘটনা জানান। কিন্তু ভারী বৃষ্টি হওয়ায় তিনি একা ডলফিন ও মা মাছটি ডাঙায় তুলে আনতে পারেননি।
জানতে চাইলে রাউজান উপজেলা মৎস্য সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন আজ মঙ্গলবার সকালে প্রথম আলোকে ঘটনাটির সত্যতা স্বীকার করে বলেন, রাতে ফোনে তিনি ঘটনাটি জেনেছেন তবে ভারী বৃষ্টি এবং রাত গভীর হওয়ায় মৎস্য বিভাগের কেউ নদীতে যেতে পারেননি।
এ নিয়ে গত ১২ দিনে হালদায় ২টি বড় ডলফিন, ৬ টি মা মাছ মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। মৎস্য অধিদপ্তর ও হালদার স্বেচ্ছাসেবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এর আগে গত রোববার বিকেলে রাউজানে একই স্থান পশ্চিম গুজরা ইউনিয়নের আজিমের ঘাট থেকে ২০ কেজি ওজনের মরা কাতলা মাছ উদ্ধার করেন নদীর স্বেচ্ছাসেবকেরা। গত শুক্রবার দুপুরে নদীর হাটহাজরী উপজেলা অংশের উত্তর মাদার্শা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কুমারখালী ঘাট এলাকা দিয়ে ভেসে যাওয়ার সময় নদীর স্বেচ্ছাসেবকেরা দুটি মা কাতলা মাছ ডাঙায় তুলে আনেন। পরে একই দিন বিকেল তিনটায় উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তর, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও হালদার স্বেচ্ছাসেবীরা মিলে একটি মাটি চাপা দেন। অপরটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে পাঠানো হয়। এ ছাড়া গত বুধবার বিকেলে রাউজান উপজেলার উরকিরচর ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাকর আলী চৌধরী ঘাট এলাকায় একটি ১২ কেজি ওজনের মরা মা কাতলা মা মাছ ভেসে যাওয়ার সময় নদী থেকে তুলে আনেন স্বেচ্ছাসেবীরা।
তার আগে মঙ্গলবার বিকেলে নদীর হাটহাজারী অংশের গড়দোয়ারা সিপাহীঘাট এলাকায় ৯০ কেজি ওজনের একটি বড় ডলফিন মরে ভেসে ওঠে।
গত এক সপ্তাহ আগে নদীর উরকিরচরের বাকর আলী চৌধুরীঘাটে আরেকটি ১২ কেজি ওজনের মরা কাতলা নদীতে ভেসে এলে সেটি ডাঙায় তুলে মাটি চাপা দেওয়া হয় বলে জানিয়েছিল উরকিরচর ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মুহাম্মদ কাউসার আলম।
এদিকে প্রজনন মৌসুমে প্রাকৃতিক প্রজনন কেন্দ্র নদীর জীববৈচিত্র্যে একের পর এক দুঃসংবাদে উদ্বিগ্ন নদী গবেষকেরা। তাঁরা বলছেন, প্রজনন মৌসুমের শেষ হতে চলল প্রায় গত তিন মাস। এখনো পুরোদমে মা মাছেরাও এবার ডিম ছাড়েনি। এ মৌসুমে গত ৭ মে স্বল্প পরিমাণে ডিম ছেড়েছিল মা মাছ। সংগ্রহকারীরা আশায় ছিল বজ্র–বৃষ্টিতে পুরোদমে ডিম ছাড়বে কিন্তু দেড় মাসেও আর তা ঘটেনি।
নদী গবেষক এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান ও চবির হালদা গবেষণাগারের সমন্বয়ক মনজুরুল কিবরিয়া প্রথম আলোকে বলেন, রাতেই তিনি ঘটনাটি জেনেছেন এবং ভাসতে থাকা মরা ডলফিন ও মাছের ছবি পেয়েছেন। তিনি বলেন, একের পর এক এ পর্যন্ত গত ১২ দিনে দুটি ডলফিন ও ৬টি মাছ নদীতে মরে উঠল, এটি বড়ই অস্বাভাবিক ঘটনা। তিনি বলেন, ঘটনার উৎস দূষণসহ অন্যান্য বিষয়গুলো নিয়ে তাঁরা প্রশাসনের কর্মকর্তারাসহ সমন্বয় করে অনুসন্ধান করছেন।
গত সোমবার বিকেলে তাঁর গবেষণাগারে ডলফিন ও মাছ মরার কারণ সম্পর্কে খোঁজ নিতে তাঁর গবেষণাগারে এসেছিলেন রাউজান ও হাটহাজারীর ইউএনওসহ পরিবেশ অধিদপ্তরের একজন প্রতিনিধি। তিনি তাঁদের কাজে সহযোগিতা করছেন বলেন।