পানিশূন্য আত্রাই নদ। গত সোমবার নওগাঁর মান্দা উপজেলার ফেরিঘাট এলাকায়
পানিশূন্য আত্রাই নদ। গত সোমবার নওগাঁর মান্দা উপজেলার ফেরিঘাট এলাকায়

নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর

নদ–নদী শুকিয়ে যাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বাড়ছে। আগে ভূগর্ভের ৮০–৯০ ফুট গভীরে পানি পাওয়া গেলেও এখন ১২০ ফুট গভীরে পানি পাওয়া যাচ্ছে।

‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/ বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে/ পার হয়ে যায় গরু, পার হয় গাড়ি/ দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি/ চিকচিক করে বালি, কোথা নাই কাদা...।’ আজ থেকে অনেক আগে লেখা কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমাদের ছোট নদী’ কবিতার মতো নদীতে হাঁটুজল দূরের কথা, কোথাও পানি নেই। নদীর বুকে কোথাও ধান আর ভুট্টার চাষ করেছেন স্থানীয় কৃষকেরা। এতে নদীর তপ্ত বালু ঢেকে গেছে ফসলের সবুজ পাতায়। এই মৃতপ্রায় অবস্থা নওগাঁর প্রধান নদী আত্রাইয়ের। সম্প্রতি নওগাঁর মান্দা উপজেলার ফেরিঘাট এলাকায় গিয়ে এই চিত্র দেখা যায়।

শুধু আত্রাই নয়, নওগাঁর সব কটি নদীরই এমন করুণ দশা। এর মধ্যে রয়েছে নাগর নদও, যাকে নিয়ে কবিগুরু লিখেছিলেন বিখ্যাত ওই শিশুতোষ কবিতা। ভারত একতরফাভাবে বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার করায় এবং অনিয়ন্ত্রতভাবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করায় আত্রাই নদের মতো বরেন্দ্র অঞ্চল হিসেবে পরিচিত নওগাঁ, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ নদ-নদীর অস্তিত্ব এখন বিলীন হওয়ার পথে। 

নওগাঁ শহরের প্রবেশমুখে বাইপাস সেতুর কাছে তুলসীগঙ্গার অবস্থা মরা খালের মতো। শহরের সব বর্জ্য এসে পড়েছে এখানে। দুপাশেই অবৈধ স্থাপনা তৈরি করে চেপে ধরা হয়েছে নদীটি। অন্যদিকে নওগাঁ সদরের তাজনগর থেকে চণ্ডীপুর পর্যন্ত তুলসীগঙ্গার ১০ কিলোমিটার এখন বছরের আট-নয় মাসই গবাদিপশুর চারণভূমি। ১৯৮২ সালের পর তাজনগরে ক্রস ড্যাম দিয়ে নদীটির গতিপথ পরিবর্তন করে ছোট যমুনায় মিলিত করার ফলে এ অবস্থা হয়েছে। ছোট যমুনাতেও বর্ষা মৌসুম ছাড়া পানি থাকে না। 

 নদীতে পানি না থাকায় এবার চলতি বোরো মৌসুমে বন্ধ হয়ে গেছে অন্তত ৪০০ সেচ পাম্পের কার্যক্রম। এতে এসব সেচ পাম্পের আওতায় চাষ হওয়া কয়েক হাজার একর জমির বোরো ধানের আবাদ ব্যাহত হচ্ছে। নদীতে পানি না পেয়ে কৃষকেরা সেচের জন্য ক্রমেই গভীর ও অগভীর নলকূপনির্ভর হয়ে পড়ছেন। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে।  

অনিয়ন্ত্রিতভাবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনকেই বরেন্দ্র অঞ্চলে পানিসংকটের অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। অনিয়ন্ত্রিতভাবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে জেলার উঁচু এলাকা নিয়ামতপুর, পোরশা, সাপাহার ও পত্নীতলা উপজেলার অধিকাংশ এলাকায় দিন দিন খাবার ও সেচের পানির সংকট প্রকট হচ্ছে। এসব এলাকায় হস্তচালিত নলকূপ দূরের কথা গভীর নলকূপেও পানি উঠছে না ঠিকমতো। বছরের অধিকাংশ সময় পানির অন্যতম উৎস পুকুর-জলাশয়েও পানি থাকছে না। 

নওগাঁর পোরশা উপজেলার ছাওড় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘আগে আমাদের এলাকায় ৮০-৯০ ফুট গভীরে পানি পাওয়া যেত। গত তিন-চার বছর ধরে পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। বর্তমানে কোনো কোনো এলাকায় ১২০ ফুট বোরিং করেও পানি পাওয়া যায় না। টাকা খরচ করে অনেক গভীর পর্যন্ত বোরিং করে পানি পাওয়া গেলেও পানির প্রবাহ খুব পাওয়া যাচ্ছে। আগে নলকূপে পানি উঠত। এখন আর নলকূপে পানি ওঠে না।’ 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নওগাঁ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, নওগাঁর ১১ উপজেলায় ৪ হাজার ১৬৫টি নলকূপ রয়েছে। বিদ্যুৎ ও ডিজেলচালিত অগভীর নলকূপ রয়েছে ৪২ হাজার ৪৯৫টি। নদী ও অন্যান্য জলাশয় থেকে পানি তুলে জমিতে সেচ দেওয়ার জন্য এলএলপি সেচযন্ত্র চালু আছে ৩ হাজার ৯৫টি।