ময়মনসিংহ

যুবলীগ কর্মী হত্যার নেপথ্যে প্রতিমন্ত্রী-উপজেলা চেয়ারম্যানের লোকদের আধিপত্যের দ্বন্দ্ব

ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় যুবলীগ কর্মী হত্যার প্রতিবাদে মহাসড়কে লাশ রেখে বিক্ষোভ। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে পৌর শহরের বাসস্ট্যান্ড এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা পৌর শহরের চৌরঙ্গী মোড় এলাকায় অটোরিকশার চাঁদা তোলা নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে যুবলীগ কর্মী মো. আসাদুজ্জামানকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। আসাদুজ্জামান মুক্তাগাছা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই আকন্দের অনুসারী। হত্যায় অভিযুক্ত ব্যক্তিরা স্থানীয় সংসদ সদস্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মুক্তাগাছায় আওয়ামী লীগের রাজনীতি দুটি ধারায় বিভক্ত। এক পক্ষের নেতৃত্বে আছেন সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। আর অপর পক্ষের নেতৃত্ব দেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল হাই আকন্দ। ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এ বিরোধের সৃষ্টি হলেও গত ছয় মাসে তা চরম আকার ধারণ করেছে। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে আওয়ামী লীগের এ বিরোধ ছড়িয়েছে যুবলীগের মধ্যেও।

মুক্তাগাছা পৌরসভার মেয়র মো. বিল্লাল হোসেন সরকার প্রতিমন্ত্রীর পক্ষে রয়েছেন। বিল্লাল হোসেনের জামাতা মাহবুবুল আলম ওরফে মনি উপজেলা যুবলীগের সভাপতি এবং জেলা পরিষদের সদস্য। মূলত তিনিই সব ধরনের বিরোধে প্রতিমন্ত্রীর পক্ষে নেতৃত্ব দেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।

যুবলীগ কর্মী মো. আসাদুজ্জামান

উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল হাই আকন্দ প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাঁচ থেকে ছয় মাস ধরে প্রতিমন্ত্রী (কে এম খালিদ) আমাদের নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে একের পর এক নেতা-কর্মীদের মারধর করাচ্ছেন তাঁর কর্মীদের দিয়ে। সবশেষ আমাদের কর্মী আসাদুজ্জানকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা এ হত্যার তীব্র নিন্দা জানাই ও দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি চাই।’

তবে প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ অবশ্য রাজনৈতিক দ্বন্দের কথা অস্বীকার করেছেন। তিনি আজ বুধবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মুক্তাগাছায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে কোনো বিরোধ নেই। আমরা ভালো আছি। যুবলীগ কর্মী আসাদুজ্জামান হত্যার ঘটনাটি দুঃখজনক। আমি ইতিমধ্যে পুলিশকে বলেছি, যাঁরাই এ ঘটনার সঙ্গে যুক্ত থাকুক না কেন, তাঁদের আইনের আওতায় আনা হোক।’

আসাদুজ্জামান হত্যার ঘটনায় আজ দুপুর ১২টা পর্যন্ত মামলা হয়নি। মুক্তাগাছা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল মজিদ বলেন, আসাদুজ্জামান মারা যাওয়ার আগে হত্যার সঙ্গে যুক্ত কয়েকজনের নাম বলে গেছেন। মামলা না হলেও গতকাল মঙ্গলবার যুবলীগ কর্মী রাজীব, শহীদুল ও সামিউলকে আটক করা হয়েছে। তাঁরা যুবলীগ নেতা মাহবুবুল আলমের পক্ষের লোক হিসেবে পরিচিত বলে জানায় পুলিশ।

পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কয়েক মাস আগে মুক্তাগাছা পৌর শহরের চৌরঙ্গী মোড় এলাকায় অটোরিকশার চাঁদা তোলা নিয়ে মাহবুবুল আলমের সঙ্গে যুবলীগ কর্মী আসাদুজ্জামানের বিরোধ সৃষ্টি হয়। চৌরঙ্গী এলাকায় অটোরিকশার চাঁদা তোলার জন্য পৌরসভা থেকে মাহবুবুল আলম ইজারা পেলেও আসাদুজ্জামানসহ আবদুল হাই আকন্দের কর্মীরা জোর করে চাঁদা তুলতেন। এ বিরোধের জেরে মাস তিনেক আগে আসাদুজ্জামানকে মারধর করেন মাহবুবুল আলমের লোকজন। এ ঘটনায় মুক্তাগাছা থানায় মামলা হয়। ওই বিরোধের জেরে গত সোমবার রাতে আসাদুজ্জামানকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ।

এ বিষয়ে আজ মাহবুবুল আলমের মুঠোফোনে একাধিকার কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। গতকাল এ বিষয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আসাদুজ্জামান হত্যার বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। তাঁর কোনো কর্মী এর সঙ্গে যুক্ত নন।

নেতা–কর্মীরা বলছেন, ছয় মাস ধরে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুটি পক্ষের মধ্যে অন্তত পাঁচবার অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় অন্তত পাঁচটি মামলা হয়। নিহত আসাদুজ্জামান অন্তত চারটি মামলার আসামি ছিলেন। এ নিয়ে গত কয়েক মাসে স্থানীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিরতা বিরাজ করছিল।

গতকাল বিকেলে আসাদুজ্জামানের লাশ নিয়ে আবদুল হাই আকন্দের পক্ষের লোকজন মুক্তাগাছা থানার সামনে ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। পরে পুলিশের পক্ষ থেকে আবদুল হাই আকন্দকে ফোন করে এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিলে অবরোধ তুলে নেওয়া হয়।

আজ সকাল ১০টা থেকে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত সরেজমিন দেখা যায়, পৌর শহরে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। মুক্তাগাছা থানার সামনে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়ন করা হয়েছে। যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পুলিশ সর্তক অবস্থায় রয়েছে বলে জানান ওসি আবদুল মজিদ।

উল্লেখ্য, সোমবার রাত আনুমানিক ৯টার দিকে মুক্তাগাছা পৌর শহরের আটানি বাজারে একটি চায়ের দোকানে বসে চান পান করছিলেন আসাদুজ্জামান ও তাঁর বন্ধু নাহিদ। এ সময় ১৫ থেকে ২০ জন দুর্বৃত্ত তাঁদের ওপর হামলা করে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপায়। পরে আসাদুজ্জামানকে একটি নর্দমায় ফেলে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়। স্থানীয় লোকজন আসাদুজ্জামান ও নাহিদকে উদ্ধার করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আসাদুজ্জামান মারা যান। নাহিদ ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।